বিশ্লেষণ
গাজা প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি দুমুখো
গাজায় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের খোলামেলা সমর্থন নিয়ে বহু ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকদের মতে, তিনি যা করছেন, তাতে যেমন ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষা হবে না, তেমনই ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবিদাওয়া পূরণ হবে না। তাঁর এ রকম অবস্থানকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা বলেও মনে করা হচ্ছে। ইসরায়েল–ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাইডেনের দুমুখো নীতি নিয়ে লিখেছেন হাসান ফেরদৌস
একই সঙ্গে দুই নৌকায় পা দেওয়ার চেষ্টা করলে তার ফল একটাই, সখাত সলিলে মৃত্যুর আশঙ্কা। গাজা নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখন তেমন আশঙ্কার মুখে। একই মুখে তিনি দুই কথা বলছেন। একদিকে তিনি ইসরায়েলকে ধমক দিচ্ছেন, অন্যদিকে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র পাঠাচ্ছেন। মুখে বলছেন, রাফা আক্রমণ হলে তা হবে ‘লাল সীমারেখা’ লঙ্ঘন। সেই রাফা যখন যুক্তরাষ্ট্রের বোমা দিয়ে উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের খুন করা হয়, তাঁর মুখপাত্র হাত কচলে বলেন, না, বাইডেনের ধরে দেওয়া সীমারেখা লঙ্ঘিত হয়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট কি পৃথিবীর মানুষকে নির্বোধ মনে করেন?
৭ অক্টোবরে হামাসের সন্ত্রাসী হামলার পর বাইডেন তড়িঘড়ি করে ইসরায়েলে এসে নিজেকে ‘জায়নবাদী’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। সপ্তাহ না যেতেই তিনি টের পেলেন, ইসরায়েলে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হলেও নিজ দেশের মুসলিম ও আরব ভোটাররা তাঁর ওপর বেজায় ক্ষিপ্ত। ২০২০ সালের নির্বাচনে এরা তাঁর ‘নিরাপদ ভোটব্যাংক’ ছিল।
গাজা প্রশ্নে তাঁর ইসরায়েল-প্রীতির ফলে সেই আরব-মুসলিম ভোটাররা ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। অবস্থা সামাল দিতে তখন কিছুটা গোপনে, তথ্যমাধ্যমের লোকদের না জানিয়ে, তিনি হোয়াইট হাউসে মুসলিম নেতাদের ডেকে তাঁদের কাছে ‘ক্ষমা’ চাইলেন। তাতে অবশ্য চিড়ে ভেজেনি। সেই সভাতেই মুসলিম নেতারা তাঁদের অসন্তোষের কথা জানালেন। আপনি একদিকে গাজায় বেসামরিক নাগরিক হত্যায় উদ্বেগ দেখাচ্ছেন, আবার জাহাজবোঝাই অস্ত্র পাঠাচ্ছেন। এমনকি গাজার স্বাস্থ্য দপ্তরের পাঠানো হতাহতের হিসাব মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ফিলিস্তিনি–যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারকর্মী রামি নাশাশিবলি। বাইডেনের মুখের ওপরে তিনি বলেই বসলেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনার কি কোনো ধারণা আছে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে যখন আপনি প্রশ্ন তোলেন, তখন আমাদের কাছে তা কী রকম নিষ্ঠুর ও পরিহাসময় মনে হয়?
সেটা গত বছর নভেম্বরের কথা। এরপর আরও ডজনখানেক সময় বাইডেন মুখের এক কোনা দিয়ে ইসরায়েলের সমালোচনা করেছেন, অন্যদিকে তাদের জাহাজবোঝাই অস্ত্র পাঠিয়েছেন। তিনি নিজে স্বীকার করেছেন, গাজায় ইসরায়েল যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো বোমাও রয়েছে। সেসব বোমার আঘাতেই বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু হচ্ছে। সে কথা উল্লেখ করে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন বলেন, ইসরায়েল সংযত না হলে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে অস্ত্র পাঠানো সাময়িক হলেও বন্ধ করবে।
■ ইসরায়েলে বাইডেনের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হলেও নিজ দেশের মুসলিম ও আরব ভোটাররা তাঁর ওপর বেজায় ক্ষিপ্ত।
■ ‘আসলে সব পক্ষকে খুশি করার চেষ্টায় বাইডেন একবার এক কথা বলছেন, পরক্ষণেই ভিন্ন কথা।’
■ তিনি যা করছেন, তাতে যেমন ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষা হবে না, তেমনই ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবিদাওয়া পূরণ হবে না।
■ সামনে নির্বাচন, সে কথা মাথায় রেখে বাইডেনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি একেবারে তেলেঝোলে একাকার।
বস্তুত, এই তথাকথিত ‘পজ’ বা সাময়িক বিরতি স্থায়ী ছিল মাত্র চার দিন। ৯ মে অস্ত্র প্রেরণে ‘বিরতি’ ঘোষণার খবর বাসি হতে না হতেই ১৫ মে বাইডেন প্রশাসন কংগ্রেসকে জানায় যে তারা ইসরায়েলকে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাঠাচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সালিভান সিবিএস নিউজকে জানান, ‘আমরা ইতিপূর্বে অনুমোদিত অস্ত্রের পুরো চালান পাঠাব। ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমাদের কথার কোনো নড়চড় হবে না।’
এরা কি পৃথিবীর মানুষকে উল্লুক মনে করে?
প্রায় একই রকম মন্তব্য করেছেন ওয়াশিংটনের আরব সেন্টারের পরিচালক ইউসেফ মুনায়ের। ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেছেন, একই সঙ্গে দুরকম কথা বলার ফলে বাইডেন প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। ‘আসলে সব পক্ষকে খুশি করার চেষ্টায় বাইডেন একবার এক কথা বলছেন, পরক্ষণেই ভিন্ন কথা।’
সামনে নির্বাচন, সে কথা মাথায় রেখে বাইডেনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি একেবারে তেলেঝোলে একাকার।
বাইডেন যে একই সঙ্গে ইসরায়েলের সমালোচনা ও তাকে নিজের ছাতার তলে আশ্রয় দিচ্ছেন, তার সর্বশেষ উদাহরণটি আরও চমৎকার। টাইম ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, কোনো সন্দেহ নেই নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য নেতানিয়াহু যুদ্ধ প্রলম্বিত করছেন। মঙ্গলবার সেই তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বললেন, না, যুদ্ধ নিয়ে নেতানিয়াহু কোনো রাজনীতি করছেন বলে মনে হয় না। বরং যে কঠিন চ্যালেঞ্জের তিনি সম্মুখীন, তা সামলাতে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।
আপনার কোন কথাটা ঠিক, মিস্টার প্রেসিডেন্ট?
আরও একটা উদাহরণ দিই। মুখে মুখে অনেকবারই অস্ত্র না পাঠানোর কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। অথচ তাঁর প্রশাসন ইসরায়েলকে অতিরিক্ত এক স্কোয়াড্রন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রেরণের ব্যাপারে নতুন চুক্তি ঘোষণা করেছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক সাবেক কর্মকর্তা, জশ পল, গাজায় মার্কিন নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন, বাইডেন প্রশাসনের ঠিক এই মুহূর্তেই যে এই রকম একটি চুক্তি ঘোষণা করতে হলো, তাতে স্পষ্ট তারা গাজায় যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে মোটেই ‘সিরিয়াস’ নয়।
বাইডেনের এই দুমুখো অবস্থান কতটা ক্ষতিকর, সে কথা খোলাসা করে বলেছেন ব্রুকিংসের শিবলি তেলহামি। তাঁর কথায়, বাইডেন এক বিপজ্জনক খেলায় নেমেছেন। তিনি যা করছেন, তাতে যেমন ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষা হবে না, তেমনই ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবিদাওয়া পূরণ হবে না।
আমরা জানি, বাইডেন মুখে মুখে গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক আইনের কথা বলতে ভালোবাসেন। জর্ডানের বাদশা আবদুল্লাহ সেদিকে কটাক্ষ করে মন্তব্য করেছেন, বাইডেন নিজের সুবিধামতো আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ করতে ভালোবাসেন। হামাসের হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, কিন্তু ইসরায়েল যখন সেই একই আইন তিন গুণ লঙ্ঘন করে, তখন তাঁর মুখে রা নেই। কেন, ফিলিস্তিনি জীবনের মূল্য কি ইসরায়েলি জীবনের চেয়ে কম?
বস্তুত, আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের প্রশ্নে বাইডেন প্রশাসন কতটা ‘সিলেকটিভ’, তার সেরা উদাহরণ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি কর্তৃক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ও যুদ্ধমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া। সে ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে বাইডেন প্রশাসন তাঁকে অযৌক্তিক, অভাবিত ও বেআইনি বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। গাজায় কোনো জেনোসাইড বা জাতিহত্যা হচ্ছে না, আইসিসি যা করছে তা ভুল, বাইডেন নিজে সে কথা বলেছেন।
এক বছর আগে (১৩ মার্চ ২০২৩) সেই আইসিসি থেকে যখন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলো, প্রেসিডেন্ট বাইডেন রীতিমতো হাততালি দিয়ে বললেন, বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে। ‘কোনো সন্দেহ নেই ইউক্রেনে যা হচ্ছে তা জেনোসাইড,’ তিনি বললেন।
মার্কিন কংগ্রেস অবশ্য বাইডেনের চেয়েও দেড় গুণ সরেস। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক—উভয় দলের সদস্যদের প্রায়-ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত এক প্রস্তাবে মার্কিন কংগ্রেস শুধু যে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে তা–ই নয়, আইসিসির কৌঁসুলি করিম খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগাম হুমকি দেয়।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র মুখে আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষে নিজের সমর্থন যত ঢাকঢোল পিটিয়ে জানান দিক না কেন, তারা নিজেরাই আইসিসিকে স্বীকৃতি জানায়নি। কারণ একটাই, পৃথিবীর নানা প্রান্তে কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যেসব বেআইনি কাজ করে চলেছে, আইসিসির আইনগত বৈধতা মেনে নিলে একদিন না একদিন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তাদের বিরুদ্ধেও জারি হতে পারে, এই ভয়।
ইসরায়েল প্রশ্নে বাইডেনের পরস্পরবিরোধী নীতির ফল দাঁড়িয়েছে এই যে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এখন আর বাইডেন বা মার্কিন প্রশাসনকে বিশ্বাস করে না। তাঁকে কেউ ভয়ডর করে বলেও মনে হয় না। গত সপ্তাহে বাইডেন মহাসমারোহে গাজার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব করে তিন দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন।
হামাস ও ইসরায়েল উভয়ের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেই প্রস্তাবটা করা হয়েছিল। হামাস প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে সে প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাঁর ক্যাবিনেটের মতামত উপেক্ষা করে বলে বসলেন, হামাস নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির প্রশ্নই ওঠে না।
ইসরায়েল, যে কিনা যুক্তরাষ্ট্রের পোষা ‘পুডল’ (ছোট আকারের কুকুর), সে–ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখের ওপর বলে দিচ্ছে তাঁর কথাকে সে থোড়াই পাত্তা দেয়। অবশ্য এ কথাও ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র যদি চায়, নেতানিয়াহুকে কাবু করা তার জন্য কঠিন কোনো ব্যাপার নয়।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেফ্রি স্যাকস মনে করেন, বাইডেন সত্যি সত্যি চাইলে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন এক দিনে বন্ধ করা সম্ভব। তিনি তা করবেন না ইসরায়েলের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত আনুগত্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবির চাপ—এই দুই কারণে।
গাজা প্রশ্নে এই একপেশে নীতি অনুসরণ করে বাইডেন হয়তো ইসরায়েলকে বাঁচাতে পারবেন, কিন্তু নভেম্বরের নির্বাচনে আরব, মুসলিম ও তরুণ ভোটারদের প্রতিরোধের ফলে নিজের গদি সামলাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে।
● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক