বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রধানতম কারণ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা, প্রকৃত নির্বাচনহীন অগণতান্ত্রিক শাসন, জবাবদিহিহীনতা, লুট ও পাচারবান্ধব অর্থব্যবস্থা, ব্যাংকিং খাতে প্রাতিষ্ঠানিক নৈরাজ্য, রেগুলেটরি অক্ষমতা, রাজনৈতিকভাবে ব্যাংক পরিচালনা ও অস্বচ্ছ ঋণ ব্যবস্থাপনা, ভুল মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন, সরকারের ঘাটতি উন্নয়ন বাজেট, অপচয়ে ঠাসা সরকারি খরচের মডেল এবং সর্বোপরি ভুল জ্বালানি নীতি থেকে সৃষ্ট। হ্যাঁ, সেখানে ইউক্রেন আগ্রাসনের কিছু প্রভাব আছে, তবে বাংলাদেশ ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি করে না বলে সেটা অবশ্যই নগণ্য। এখানে আছে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কিছু প্রভাবও। তা ছাড়া বাংলাদেশের সংকট শতভাগ আরোপিত নয়; বরং আমরা নিজেরাই চলমান ডলার-সংকটের একটা বড় অংশের নির্মাতা।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব সমস্যা কি শুধু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ অর্থনৈতিক সংস্কার শর্ত মানলেই ঠিক হয়ে যাবে? একটি সার্বিক ও গুরুতর সংকট, যার অনেকগুলো রাজনৈতিক মাত্রা আছে, সেখানে রাজনৈতিক সংস্কার না করে ক্ষমতার স্বার্থে এত দিন চলতে দেওয়া লুণ্ঠন-রেন্টসিকিং-পাচার হঠাৎ বন্ধ করা যাবে কি? আইএমএফ প্রস্তাবিত শর্ত মেনে সুশাসন আনা সরকারের পক্ষে আদৌ সম্ভব কি?
আইএমএফের শর্তগুলোর অর্থ কী
আইএমএফ বিশদ প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), অর্থ মন্ত্রণালয়সহ দেশের সরকারি সংস্থাকে কাঠগড়ায় তুলে বহু যৌক্তিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তারা রিজার্ভ গণনাপদ্ধতি ঠিক করতে বলেছে, রিজার্ভ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণদান বন্ধ করতে বলেছে, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল কমাতে বলেছে। টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছাড়তে বলেছে। সরকারের বন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে কিনিয়ে টাকা ছাপানোর অপচর্চা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বছরে দুবার, সম্ভব হলে চারবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে সংবাদ সম্মেলনে নীতির যৌক্তিকতা তুলে ধরার পরামর্শ দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি ও জিডিপির অস্বচ্ছ হিসাবপদ্ধতিতে সংস্কার আনতে বলেছে। দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন করেছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোয় আপত্তি করেছে। ৯০ দিনে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেই খেলাপি ঘোষণার শর্ত দিয়েছে। ৬ থেকে ৯ শতাংশের সুদহারের সীমা বন্ধ করতে বলেছে।
ব্যাংকে ‘আমলা’ পরিচালক নিয়োগ বন্ধ করতে বলেছে (খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকেও আমলা গভর্নর!)। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে কর ও শুল্ক অব্যবহিত কমাতে বলেছে, ভ্যাট বাড়াতে বলেছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমাতে বলেছে। বিদ্যুতের কুইক রেন্টাল ও ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধের ব্যাপারে জানতে চেয়েছে। পিডিবির লোকসানের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ (বেইলআউট) বন্ধ করে ব্যাংক লোনের মাধ্যমে পিডিবির অর্থসংস্থানের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বলেছে। মধ্যবিত্ত দেশের মর্যাদাপ্রাপ্তি অর্থাৎ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরে বর্ধিত সুদের হার, আর্থিক ও মেধাস্বত্ববিষয়ক ক্ষতির সংস্থান জানতে চেয়েছে।
রিজার্ভের হিসাবপদ্ধতি পরিবর্তন করলে, ঘোষিত রিজার্ভ অনেক কমে যাবে, ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান পড়তে পারে। বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট করা হয়, তা স্থায়ী করা যাবে না বলে জানিয়েছে আইএমএফ। কিন্তু ডলারের বিনিময়মূল্য বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেও টাকার মূল্যমান কমে যেতে পারে। সরকার ঋণপত্র খুলতে বাধা দিচ্ছে বলে খোলাবাজারে ডলার-সংকট প্রকট। টাকার মান পড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে, তবে আমদানি কমে আসবে, রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। এতে বাড়তে পারে প্রবাসী আয়ও। প্রবাসী আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ প্রণোদনা তুলে দিয়ে ডলারের দাম আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেয় সংস্থাটি।
৬ থেকে ৯ সুদের হারের স্থির নীতি বন্ধ করলে, আমানতের সুদহার বাড়বে। নিম্ন আমানত সুদহার উঠিয়ে দিলে সরকারের সঞ্চয়পত্র ঋণ কমে এসে ব্যাংকের তারল্য-সংকটের একটা সমাধান আসবে। নতুন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ না করে পুরোনো ঋণ ফেরতের অপচর্চা থামবে। মূল্যস্ফীতির অনেক কম হারে অতি সস্তায় ঋণাত্মক সুদে ঋণ নিয়ে একটা অংশ পাচারের লাগাম টানা যাবে। শিল্প ঋণের সুদ বাড়লে উৎপাদন কমে আসবে, কিন্তু এতেও পণ্য উৎপাদনের খরচ (বর্ধিত কাঁচামাল ও জ্বালানি আমদানি খরচসহ) বেড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এমন পলিসির বিপরীতে নিম্নবিত্ত ও গরিবদের সামাজিক সুরক্ষা ভাতা ব্যাপকভাবে বাড়ানোর দরকার। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজস্ব আয়ের প্রায় সমপরিমাণ ঋণ করা সরকার প্রশাসনের খরচ কমিয়ে দরকারি কৃচ্ছ্রসাধন করে সামাজিক সুরক্ষা ভর্তুকি বাড়াতে পারবে কি?
জ্বালানি, সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি সংস্কারের ক্ষেত্রে আইএমএফের কিছু শর্তে আপত্তি করার আছে। বাংলাদেশকে মৌলিক খাত হিসেবে জ্বালানি, সার, বিদ্যুৎ, কৃষির দরকারি ভর্তুকি চালিয়ে যেতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম সহনীয় রাখতে না পারলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি শোচনীয় পর্যায়ে চলে যাবে। তবে অবশ্যই ক্যাপাসিটি চার্জ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সিস্টেম লস, প্রকল্প বাস্তবায়নে অপখরচ দুর্নীতি, তেল-গ্যাস কেনায় স্পট মার্কেট কমিশনের দুর্বৃত্তায়ন ও অপচয় বন্ধ করতে হবে। ভর্তুকি কমানোর অর্থ কোনোভাবেই জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানো হতে পারে না।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন (বাসেল-ত্রি), খেলাপি ঋণ সংজ্ঞায়ন, রিজার্ভ মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি গণনাপদ্ধতি সংস্কারসংক্রান্ত বহু আইএমএফ শর্ত যৌক্তিক। নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত নিয়ে আইএমএফ উদ্বেগ যথার্থ তবে শুল্কছাড় কমালে, ভ্যাট বাড়ালে তা সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা তৈরি করে বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে। আইএমএফকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাঁদাবাজির পরোক্ষ কর বন্ধে আমলা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কর ফাঁকি নিয়ে সজাগ হতে হবে। অর্থাৎ, হোরাইজন্টাল ট্যাক্সেশানের বদলে ভার্টিক্যাল ট্যাক্সেশান নিয়ে কথা বলতে হবে। অর্থপাচার বন্ধ করা এবং কোটিপতি বৃদ্ধির বৈষম্যপূর্ণ হার নিয়ে আইএমএফকে তৎপরতা দেখাতে হবে। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে সব কর অঞ্চলে উৎসে আয়কর কাটার জন্য স্বয়ংক্রিয় চালান ব্যবস্থা চালু করা এবং ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট সিস্টেমের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রস্তাব যৌক্তিক।
জ্বালানি, সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি সংস্কারের কিছু শর্তে আপত্তি করার আছে। বাংলাদেশকে মৌলিক খাত হিসেবে জ্বালানি, সার, বিদ্যুৎ, কৃষির দরকারি ভর্তুকি চালিয়ে যেতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম সহনীয় রাখতে না পারলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি শোচনীয় পর্যায়ে চলে যাবে। তবে অবশ্যই ক্যাপাসিটি চার্জ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সিস্টেম লস, প্রকল্প বাস্তবায়নে অপখরচ দুর্নীতি, তেল-গ্যাস কেনায় স্পট মার্কেট কমিশনের দুর্বৃত্তায়ন ও অপচয় বন্ধ করতে হবে। ভর্তুকি কমানোর অর্থ কোনোভাবেই জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানো হতে পারে না। তবে উন্নত বিশ্বের আদলে বিদ্যুৎ-জ্বালানির স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের সূত্র তৈরির পরামর্শ সমর্থনযোগ্য, এতে স্থানীয় পণ্যের দাম বিশ্ব বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। আইএমএফের আরেকটি শর্ত হতে পারে, কার্বন ট্যাক্স প্রবর্তন, কিন্তু এটা শুধু ধনীর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি উত্তরণে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নে কঠিন শর্ত আরোপও কিছু ক্ষেত্রে যৌক্তিক। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিল্প ও বৃহৎ ব্যবসা ঋণের কিস্তি না দিলে ৯০ দিনের মধ্যে খেলাপি করার আইএমএফ প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ, তবে কৃষি ও এসএমই খাতকে এর আওতামুক্ত রাখা জরুরি।
দেশের পরিসংখ্যান মান, আর্থিক খাতের তথ্য স্বচ্ছতা নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। আরও দুটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাব হচ্ছে—সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানোর পরামর্শ এবং সরকারের ব্যাংক ঋণের তথ্য প্রতি তিন মাস অন্তর প্রকাশ। রেপো, ওপেন পজিশান লিমিট, ইআরকিউ কোটা ইত্যাদি করোনা পূর্ববর্তী অবস্থায় ফেরাতে বলেছে। দুর্বল হয়ে যাওয়া ১০ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে জানতে চেয়েছে। প্রতিটি বিষয় দরকারি ও গুরুত্বপূর্ণ।
আইএমএফের ঋণ এত জরুরি কেন?
দুই বছরে ১৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ করেছে যে দেশ সেই দেশের সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ কেন এত জরুরি—এই প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। আইএমএফ দাতা নয়, ঋণদাতা সংস্থা। সদস্য দেশগুলোর অর্থ অন্য দেশে ঋণ হিসেবে লগ্নি করে আইএমএফ। এর মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক আর্থিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা নিশ্চিত করে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করে, বেসরকারি খাত শক্তিশালীকরণে ভূমিকা রাখে, আন্তর্জাতিক লেনদেনে অর্থ প্রদানের ভারসাম্য সমস্যায় পড়া সদস্যদের দেশের জন্য আর্থিক সংকট থেকে পুনরুদ্ধারে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে এবং সংস্কারের শর্তে ঋণ প্রদান করে।
এটা স্বীকৃত যে সংকটাপন্ন দেশ আইএমএফ প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনে। আইএমএফ সংস্কারের শর্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা ওই দেশের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অপশাসন এবং আর্থিক খাতের নৈরাজ্য বন্ধের একটা সাময়িক সংকেত পায়। সংকটাপন্ন কিংবা দেউলিয়া রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বৈদেশিক ঋণ ও দেনার পরিস্থিতি থেকে আপাত উত্তরণ ঘটে। তবে অভিযোগ আছে যে আইএমএফ সংকটে পড়া দেশে কৃচ্ছ্র বা অস্টারিটির নামে পাবলিক স্পেন্ডিং কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ, সামাজিক সুরক্ষা ও ভর্তুকি কমিয়ে কৌশলে পুঁজিবাদী বেসরকারীকরণকে উৎসাহ দেয়। অর্থাৎ দুর্নীতি, অপশাসন ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল প্রশ্নে আইএমএফ কার্যত নির্বিকার থাকে, বরং ক্ষেত্রভেদে পশ্চিমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়কে কৌশলে পলিসিতে নিয়ে আসে। বলা হয়ে থাকে, আইএমএফ পরামর্শ মেনে পৃথিবীর কোনো দেশ আদৌ প্রকৃত ধনী হয়নি!
বাংলাদেশ ২০১২ থেকে ২০২২, মাত্র এই দশ বছরে শুধু বিশ্বব্যাংক থেকেই ২২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার রেকর্ড প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ করেছে! প্রধানত মহামারি চলাকালে সহায়তা এবং মেগা প্রকল্প ঋণ মিলে ২০২০-২২ দুই অর্থবছরে, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ৩২ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে, এর মধ্যে ১৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ সরকারি। ২০২১ সালে সুদসহ দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, বেসরকারি খাতের দায় ১৮ বিলিয়ন ডলার, ৫ বিলিয়ন ডলার সরকারের। আগামী বছর সুদসহ ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।
অর্থাৎ বিগত দশকে অধিক ঋণ করায় বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের কিস্তি বেড়েছে, মেগা প্রকল্পের দায় ও বকেয়া বেড়েছে, বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জের মাত্রাতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে। নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও সংস্কার করেনি বলে সবুজ বিদ্যুৎ নীতি বাস্তবায়ন করেনি বলে জ্বালানি আমদানির চাপ অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে ওপেকভুক্ত দেশ থেকে বৃহদাকারে স্থায়ী জ্বালানি আমদানি চুক্তির অভাবে, স্পট মার্কেটের উচ্চ দামে কেনার মাধ্যমে তৈরি করা সংকট শুরু হয়েছে। করোনার পরে রপ্তানির তুলনায় আমদানি ব্যাপক বাড়ায় (আমদানিতে ওভার-ইনভয়েসিং পাচারের অভিযোগও আছে) বর্তমানে বাংলাদেশ ডলার-সংকটে পড়ে গেছে। আইএমএফের হিসাবে প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়ায় প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সব বকেয়া, দায়দেনা ও ঋণের কিস্তি পরিশোধের পরে সরকারের হাতে খরচযোগ্য রিজার্ভ থাকে মাত্র ১৭ বিলিয়ন ডলার! এ কারণে সরকারকে জরুরি ঋণপত্র বন্ধ করতে হচ্ছে, জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে পরিকল্পিত বিদ্যুতের সংকট তৈরি করতে হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, মাত্র সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে আইএমএফ যেসব অপ্রীতিকর ও কঠিন শর্ত দিচ্ছে, প্রশ্ন তুলেছে, তাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সচেতন সরকারের মানসম্মান থাকছে তো? যদিও আর্থিক খাতে সুশাসন ফেরাতে অনেকগুলো শর্ত মানা বাংলাদেশের জন্য জরুরি।
ঋণের অর্থে কী করা হবে?
জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, বছরে মাত্র দেড় বিলিয়ন আইএমএফ ঋণ দিয়ে বাংলাদেশ কী করবে? ইভিএম কিনবে? ৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণের কিস্তি দেবে? প্রাথমিক জ্বালানি, সার, খাদ্য, ওষুধের কাঁচামাল কিনবে? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ডলার বিক্রি করে সরকারি আমদানির দায় মেটাবে? ইডিএফ তহবিল কিংবা পাচার সহায়ক এলসি সাপোর্ট দেবে? বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের ডলার পেমেন্ট ও জ্বালানি আমদানির ভর্তুকি ও বকেয়া দেবে? অবকাঠামো প্রকল্প কিংবা মেগা প্রকল্পের বকেয়া দেবে? আমলা-সচিব, মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির বিদেশ সফরের খরচ, বিদেশি মিশনের বাড়বাড়ন্ত খরচ জোগাবে? বিদেশে লবিস্টের পিছে ডলার ঢালবে? নাকি শিল্পের মূলধনী যন্ত্র এবং কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্রে ডলার ছাড় দেবে? নাকি আর্থিক খাতে ‘আইএমএফ সংস্কার পলিসি’ বাস্তবায়ন করে সুশাসন ফেরাবে! উত্তরটা সময়ই বলে দেবে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। [email protected]