এ সপ্তাহে টক অব দ্য টাউন ছিল হঠাৎ করেই রাজপথে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি। এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একটি কল রেকর্ড। ফাঁস হওয়া রেকর্ডটি শেখ হাসিনার কি না, সেটা নিশ্চিত নয়। আগে আমরা দেখেছি, বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে কারও কণ্ঠস্বর নকল করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
যা হোক, বিদেশে বসে আওয়ামী লীগের অনেকে ফেসবুক ও ইউটিউবে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা করে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে আমরা জানতে পারি, ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে দলটি একটা শোডাউন করবে।
নূর হোসেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শহীদ। সে সময় আওয়ামী লীগ এককভাবে আন্দোলন করেনি। আন্দোলন ছিল তিন জোটের, একই সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর। আমাদের দেশে আন্দোলনে কেউ মারা গেলে রাজনৈতিক দলগুলো মালিকানা দাবি করে। বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে নূর হোসেনের মালিকানাও দাবি করা হয়েছিল। পরে বের হলো যে তিনি ঢাকার একটি মহল্লার যুবলীগ নেতা। সুতরাং তিনি আওয়ামী লীগের সম্পত্তি!
নূর হোসেন দিবসকে উপলক্ষ করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের মাঠে নামার ঘটনাটি এককথায় দ্বিচারিতা। এটা ভণ্ডামিও। নূর হোসেন নিহত হয়েছিলেন এরশাদ জমানায়, পুলিশের গুলিতে। এরশাদকে আমরা সে সময় অনেকে ‘খুনি’ বলতাম। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছি যে সেই খুনি এরশাদ পরবর্তী সময়ে হয়ে গেলেন আওয়ামী লীগের পরম মিত্র। স্বয়ং শেখ হাসিনা তাঁর সরকারে এরশাদকে বিশেষ দূত করেছেন। রাজনীতিতে পুরোপুরি পুনর্বাসন করেছেন।
আওয়ামী লীগ ছুতো খুঁজছিল। নূর হোসেন দিবসকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে তারা মাঠে নামার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এটা আওয়ামী লীগের একটা ফাঁকা আওয়াজ।
আওয়ামী লীগের আমলে আমরা দেখেছি, তথ্য মন্ত্রণালয় যাঁরা চালাতেন, তাঁদের কাছে গোয়েবলসও ছিলেন শিশু। তাঁরা অনেক মিথ্যাচার করেছেন, অনেক প্রোপাগান্ডা চালিয়েছেন, অনেক গুজব ছড়িয়েছেন। তাঁদের সমালোচনা করলে কালাকানুন দিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ এনে ভিন্নমতাবলম্বীদের গ্রেপ্তার করেছেন, শাস্তি দিয়েছেন, এমনকি গুমও করেছেন।
এই মুহূর্তে একদিকে আত্মগোপনে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আস্ফালন, অন্যদিকে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতা আমরা দেখছি; পাশাপাশি সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকের মধ্যে একধরনের নিষ্ক্রিয়তাও দেখছি। সব মিলিয়ে জনমনে হতাশা বাড়ার শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। জনমনে হতাশা বাড়লে রাজনীতির জল আরও ঘোলা হতে পারে।
৫ আগস্টের পর থেকে আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুজবে সয়লাব হয়ে গেছে। ফেসবুকে এমন গুজবও আমরা দেখেছি, সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশন চলাকালে বাংলাদেশের পতাকা রাখা হয়নি। যাঁরা এগুলো ছড়ান, তাঁরা স্বল্প বুদ্ধির লোক। আবার যাঁরা এগুলো বিশ্বাস করেন, তাঁরা নির্বোধ লোক।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়েও আমরা একটা গুজব ছড়াতে দেখছি। ২০০৪-০৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে আমি কাজ করেছিলাম। ‘উপকূলীয় অঞ্চল পরিকল্পনা’ নামে প্রকল্পটিতে উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অনেকগুলো সুপারিশ করা হয়েছিল। সে সময়ের সরকার সেটা অনুমোদন দিয়েছিল। সে প্রকল্পের অনেক আগে থেকেই সেন্ট মার্টিনসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলকে প্রতিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছিল।
সেন্ট মার্টিন একটা ছোট্ট দ্বীপ। সেখানে মিঠাপানির উৎসও সীমিত। অপরিকল্পিত পর্যটন দ্বীপটিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সেন্ট মার্টিনে আমরা নিয়ন্ত্রিত পর্যটনের সুপারিশ করেছিলাম। পর্যটক নিয়ন্ত্রণের সেই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এসে সেটা পরিত্যক্ত করে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় আবার সেন্ট মার্টিনকে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়, সে বিষয় এসেছে। আওয়ামী লীগের লোকজন গুজব ছড়াতে শুরু করলেন, সেন্ট মার্টিনকে যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা একটা সস্তা গুজব।
যাহোক, ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা নানান কথাবার্তা বলছেন। হাসিনার মুখপাত্র হলেন তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। দলে আর কোনো নেতাকে দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ যে একেবারে একটা পরিবারের দল, এতেই তা প্রমাণিত হয়। কিন্তু এই দলে অনেক অনুগত লোক আছেন, অনেক দলদাস আছেন। ১৫ বছরে একটা বড় সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল।
একটা পদ, একটা চাকরি, একটা প্লট কিংবা ব্যাংকঋণের জন্য এই গোষ্ঠীর লোকেরা আওয়ামী লীগের কাছে তঁাদের আত্মা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক, আমলা, পুলিশ, প্রশাসনে আওয়ামী লীগের যাঁরা অনুগত লোক আছেন, তাঁরা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে জল ঘোলা করার চেষ্টা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
আওয়ামী লীগের জমায়েত করার ঘোষণার প্রতিক্রিয়া হলো, ১০ নভেম্বর বিএনপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসহ আওয়ামী লীগবিরোধী যারা আছে, তারা সবাই মাঠে নেমে গেল। তারা এটাকে খুবই গুরুত্ব দিল। কিন্তু তারা যে প্রতিক্রিয়া জানাল, সেটাকে আমার কাছে অতি প্রতিক্রিয়া বলে মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগের জমায়েত করার ঘোষণা শেষ পর্যন্ত পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো একটা ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কয়েকজনকে আমরা মারধর করতে দেখলাম। তাঁরা সেখানে কী করতে গিয়েছিলেন, সেটা জানি না।
যদিও ভারতের কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম তাদের খবরের শিরোনাম করেছে, ‘ট্রাম্পের সমর্থকদের ওপর ইউনূসের লোকেরা চড়াও হয়েছে’। ৫ আগস্টের পর থেকে ভারতের কিছু কিছু সংবাদমাধ্যমে শেখ হাসিনার পক্ষে ও ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবেদন ছাপিয়ে যাচ্ছে। এর অনেকগুলোই বিকৃত সংবাদ।
ভারতের বাম-ডান-মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলের মধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে একটা ঐকমত্য আছে। ভারতের রাজনৈতিক মহল চায় বাংলাদেশ তাদের একটা তাঁবেদার রাষ্ট্র হয়ে থাক। ১৫ বছর ধরে ভারতের এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে আসছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর মধ্যে দেশপ্রেম ছিল না, ছিল ক্ষমতার প্রেম। ভারত যা চেয়েছিল, তার সবকিছুই তিনি দিয়েছিলেন।
এমনকি যেটা চায়নি, সেটাও দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার সন্তানেরা বিদেশে থাকেন। তিনি বাংলাদেশকে ব্যবহার করেছেন তাঁর ক্ষমতার জন্য এবং অনুগত লোকদের লুটপাটের ব্যবস্থা করে দিতে।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটুকু? ভারত যদি এ ব্যাপারে আগ্রাসী হয়ে ওঠে, তাহলে কিছুটা সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, ভারত এ দেশে তাদের তাঁবেদার কিছু লোককে গ্রুমিং বা পরিচর্যা করে এসেছে। একসময় তারা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে পরিচর্যা করেছে।
এরশাদ ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, গণ-অভ্যুত্থানে পতনের পরও দাপটের সঙ্গে আমৃত্যু রাজনীতি করে গেছেন। ভারত জাতীয় পার্টিকে তাদের বাফার হিসেবে ব্যবহার করেছে। একসময় জাসদ সম্পর্কে বলা হতো দলটি বাংলাদেশে ভারতের ‘সেকেন্ড ডিফেন্স লাইন’; যদিও এটা ছিল পিকিংপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারণা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হাসিনার পর ভারত কাকে পরিচর্যা করবে? ইদানীং আমরা দেখছি, নির্বাচনের জন্য বিএনপির কোনো কোনো নেতা অস্থির হয়ে গেছেন। এক-এগারোর পর বিএনপিতে বিপর্যয় এসেছিল। এরপর তারা চেষ্টা করেছিল ভারতের মন জয় করতে। বিএনপির শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ২০১২ সালে ভারতে গিয়েছিলেন।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বিএনপির দিক থেকে ভারতকে একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল যে তারা আগের সেই কট্টর ভারতবিরোধী অবস্থানে থাকবে না। বিএনপি আওয়ামী লীগের বিকল্প হতে পারে। তারা ক্ষমতায় গেলে ভারতের জন্য কোনো সমস্যা হবে না।
অতীত এই অভিজ্ঞতার কারণে সন্দেহ হতেই পারে, রাজনীতিতে কোনো খেলা চলছে কি না। এই মুহূর্তে রাজনীতিতে একটা বড় বিতর্ক হলো সংস্কার আগে, না নির্বাচন আগে? সরকারের দিক থেকে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, যে কমিশনগুলো তারা করেছে, সেগুলো তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দেবে। এরপর তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে। বিএনপি বড় দল। নির্বাচনে তারা ভালো করবে, এই আশা আছে। তারা তো কিছুদিন অপেক্ষা করতেই পারে। বারবার সংবাদ সম্মেলন করে, সমাবেশ করে একই কথা কেন তারা বলছে?
বিএনপি আসলে কী চায়? বিএনপির কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন, সংস্কার নির্বাচিত সরকারের কাজ। একটা বিষয় হচ্ছে, নির্বাচিত সরকার যে সংস্কার করে না, এটাই আমাদের অভিজ্ঞতা।
এই মুহূর্তে একদিকে আত্মগোপনে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আস্ফালন, অন্যদিকে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতা আমরা দেখছি; পাশাপাশি সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকের মধ্যে একধরনের নিষ্ক্রিয়তাও দেখছি। সব মিলিয়ে জনমনে হতাশা বাড়ার শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। জনমনে হতাশা বাড়লে রাজনীতির জল আরও ঘোলা হতে পারে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক