বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে যে কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের আয় বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই পরামর্শ অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে কি না, তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তি ও শিক্ষকদের একাংশের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির সুযোগ যে তৈরি হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাজারি চাহিদার সান্ধ্য কোর্স চালুর পাশাপাশি এই আয়ের অন্যতম উৎস হলো ভর্তি পরীক্ষা।
প্রতিবছর কয়েক লাখ শিক্ষার্থীকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির যুদ্ধে শামিল হতে হয়। এ সংখ্যা এত বিশাল যে অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়েও তা বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের আয়ের জন্য এ এক দারুণ সুযোগ। ভর্তি পরীক্ষাকে সৃজনী গুণে তাঁরা ভর্তি ব্যবসার রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। বিনিয়োগ ছাড়া বিপুল মুনাফার (!) এ যেন এক টেক্সটবুক দৃষ্টান্ত। সব কটি বিশ্ববিদ্যালয় খরচ বৃদ্ধির যুক্তি তুলে বছর বছর ভর্তি পরীক্ষার ফি বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া ফি’র কত অংশ তাঁর ভর্তি সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যয় করা হচ্ছে, তার স্বচ্ছ কোনো হিসাব কেউ দিচ্ছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসির বিধি অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষার আয়ের বা মুনাফার ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। আর ৬০ শতাংশ পরীক্ষার ব্যয় মিটানোর জন্য বলা আছে। কিন্তু সেই ৪০ শতাংশের গন্তব্য কী হয়, তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে।
ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। শুধু নিয়োগকর্তা আর ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছেই তাদের দায়বদ্ধ হলে চলে। এর ফলাফল হলো, বাকি সমাজের সংস্কৃতি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি। বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য নতুন কোনো সংস্কৃতি তৈরি করতে অক্ষম। সে কারণে একজন অসৎ ব্যবসায়ী যেভাবে চিন্তা করেন, মানে সংকটকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কিংবা শিক্ষকদের একাংশ সেই একই কায়দায় চিন্তা করতে দ্বিধা করছেন না।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফি ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে প্রথম আলোয় একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে ভর্তি পরীক্ষার আয়ের গন্তব্য কোথায়, তার একটা চিত্র দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্তে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় এই অনিয়ম পাওয়া গেছে। কেতাবি ভাষায় অনিয়ম বলা হলেও এর চেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি আর কী হতে পারে? ওই শিক্ষাবর্ষে সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। আসন ছিল মাত্র ১ হাজার ৮৮৮টি। মানে ১ আসনের বিপরীতে প্রতিযোগী ছিলেন ১৯১ জন। সেই বছর ভর্তি ফি বাবদ আয় হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। এর ৪০ শতাংশ, মানে ৮ কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।
বিপুল এই টাকা গেছে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রার, শিক্ষক, কর্মকর্তাদের পকেটে। মজার বিষয় হচ্ছে, বণ্টনের ক্ষেত্রে কিন্তু অনিয়ম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁর পদবি যত বড়, তাঁর পকেটে গেছে তত বেশি টাকা। আর শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে একটা সাম্যবাদী নীতিও বজায় রাখা হয়েছে। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনের বরাতে প্রথম আলো লিখেছে, উপাচার্য সম্মানী নিয়েছেন ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়েছেন ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। রেজিস্ট্রার নিয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বণ্টন হয়েছে সাম্যবাদী নীতিতে। শিক্ষকেরা পেয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা করে। আর কর্মকর্তারা পেয়েছেন ৮২ হাজার ৫০০ টাকা করে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি পুরোপুরি সেকেলে। কোন শিক্ষার্থীর কোন বিষয়ে আগ্রহ, সে হিসেবে তাঁর ভর্তির সুযোগ নেই। বরং লটারির মতো যে যেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁকে সেখানেই পড়তে হচ্ছে। শিক্ষার সামগ্রিক দর্শনের মধ্যে মানবসম্পদ তৈরির পরিকল্পিত কোনো পরিকল্পনা নেই। ফলে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে বিপুলসংখ্যক তরুণ বেকার থেকে যাচ্ছেন। কিন্তু সমাজে সবার মধ্যে ধারণা তৈরি হয়ে গেছে উচ্চশিক্ষা নিতে পারলেই জীবন ভোজবাজির মতো পাল্টে যাবে। বিপুল এই চাহিদাই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনৈতিক বাণিজ্যের সুযোগ করে দিচ্ছে। আর সেই সুযোগটা কারা নিচ্ছেন? সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যোগ্য নাগরিক উৎপাদন করা যাঁদের দায়িত্ব সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা।
অযৌক্তিকভাবে ভর্তি পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে আর সেই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করার মতো কাজ যাঁরা করছেন, তাঁদের পক্ষে উচ্চ নৈতিকতা আর মূল্যবোধসম্পন্ন আগামীর নাগরিক তৈরি করা কতটা সম্ভব? বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে যখন এমন নৈতিক পতন ঘটে, তখন সমাজ-রাষ্ট্রে বিদ্যমান অন্ধকার আরও প্রগাঢ় হয়।
একটা সময় ছিল যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এক টাকাও বেতন-ফি বাড়ানো হলেও তার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। ছাত্রসংগঠনগুলো এর প্রতিবাদ করত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনত। অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্তের পুনর্মূল্যায়ন করত। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম গণতান্ত্রিক চর্চাটাই কাম্য। সেটাই স্বাভাবিক। এতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক জীবন্ত থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় নানা-শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থনৈতিক বা সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকে যাতে বঞ্চিত না হয়, সেই সুযোগ রাখতে হয়। কেননা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের করের টাকায়।
গত কয়েক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেই চিত্র পুরোটাই পাল্টে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়োগসহ সবকিছুই চলছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। শুধু নিয়োগকর্তা আর ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছেই তাদের দায়বদ্ধ হলে চলে। এর ফলাফল হলো, বাকি সমাজের সংস্কৃতি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি। বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য নতুন কোনো সংস্কৃতি তৈরি করতে অক্ষম। সে কারণে একজন অসৎ ব্যবসায়ী যেভাবে চিন্তা করেন, মানে সংকটকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কিংবা শিক্ষকদের একাংশ সেই একই কায়দায় চিন্তা করতে দ্বিধা করছেন না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফি নিয়ে যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছে, তার জন্য তাঁরা কি আদৌ জবাবদিহির আওতায় আসবেন? এর থেকেও বড় প্রশ্নটি হলো, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যদি এতোটা নৈতিক পতন হয়, তাহলে আশার জায়গা আর কোথায়?
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ-সহসম্পাদক