এর আগে আমরা সয়াবিন তেলের খেল দেখেছি। পেঁয়াজের আজেবাজে ঝাঁজে কপালের মাঝে চিন্তার ভাঁজ দেখেছি। কাঁচা মরিচের নাচানাচি দেখেছি। লাল মরিচের ঝাল দেখেছি। নিমকহারাম সিন্ডিকেটের কারণে নুনের বাজারেও চুনের মতো গাল পোড়ানো দাম দেখেছি। রমজান মাসে বেগুনের ওপর দিয়ে ‘গুন গুন গুন গান গাহিয়া নীল ভোমরা’ উড়তে দেখেছি। মাথায় ঝিমধরানো দামের দিক থেকে ডিম আগে না মুরগি আগে, সেই তর্কে জড়িয়ে কারওয়ান বাজারের চিকেন মার্কেটে দোকানদার-কাস্টমারের মারামারি দেখেছি।
এখন চলছে আদার ব্যাপার। ব্যাপারীরা প্রতিদিনই চীনা জাহাজের খোঁজ নিচ্ছেন। কিন্তু জাহাজ ভিড়ছে না। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁদের সাদা মনে কাদা নেই। সব নাকি আদার গডফাদারদের দাদাগিরির কারণে হচ্ছে। পাবলিক যেহেতু গাধা, সেহেতু বিনা বাধায় পেয়াদার খাজনা আদায়ের কায়দায় আদার দাম কেজিপ্রতি তিন শ থেকে পাঁচ শ টাকা আদায় করা হচ্ছে।
কেউ কিছু দেখছে না। কেউ কিছু বলছে না। ‘যেন অন্ধ, চোখ বন্ধ, যেন খঞ্জ, হাত বান্ধা’। অথচ আমদানির খরচ এর অর্ধেকও নয়। এই অন্যায়ে ব্যবসায়ী ও নজরদারি কর্তৃপক্ষের সায় থাকলেও কেউ দায় নিতে চায় না বলে পাবলিক বাড়তি ব্যয়বিষয়ক ন্যায়বিচার পায় না। বাজার দেখাশোনার রেগুলেটরি বডি আর ডেডবডির মধ্যে তেমন একটা তফাত দেখা যায় না।
বাজারে যে সাদা আদা পাওয়া যায়, বেশির ভাগই আসে চীন থেকে। কিন্তু এ বছর সেই মেইন সরবরাহকারীর সাপ্লাই চেইন ছিঁড়ে গেছে। কাগজে দেখলাম, চীনে এ বছর আদার ফলন ভালো হয়নি। ফলে জ্বলন শুরু হয়েছে বাংলাদেশের বাজারে। চীনের সরকার নিজেরাই বিদেশ থেকে নাকি কিনে আনছে আদা। আমাদের বাজারে এখন যে আদা পাওয়া যাচ্ছে, তার ৮০ ভাগই মিয়ানমারের। বাকি ২০ ভাগ আদা ভারত, ইন্দোনেশিয়া আর ভিয়েতনামের দাদারা দিচ্ছেন।
পত্রিকার খবর মারফত সরকারি নথিপত্র বলছে, পাশের দেশ থেকে আনা আদায় খরচ পড়ছে সব মিলিয়ে কেজিপ্রতি ৫৮ টাকা। আর পাবলিকের পকেটের টাকা ফাঁকা করে খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকায়।
বাজারে এখন চীনের যে আদা প্রতি কেজি ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তা মূলত ১৮৭ টাকায় আমদানি করা। তার মানে, আমদানি মূল্যের আড়াই গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চীনের আদাও। অন্য দেশ হলে এসব ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের এখানকার ক্যানসারে আক্রান্ত সেন্সর বোর্ডের সেই সেন্স হবে, এমন ফিউচার টেন্স দেখা যাচ্ছে না।
আদার ব্যাপারীকে গলাকাটা দাম নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জাহাজ মার্কা বিড়ি ধরিয়ে আড়তদারকে দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ‘উনারে জিগান।’ আড়তদারকে গিয়ে ধরলে তিনি বলেন, ‘ইমপোর্ট শর্ট আছে।’ ‘১৮৭ টাকায় আমদানি করা জিনিস কীভাবে ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়?’ এই প্রশ্নের উত্তর সোজা ভাষায় না দিয়ে কত ধরনের শারীরিক মোচড়ামুচড়ি করে দেওয়া হয়, সে এক দৃশ্য!
যেকোনো একটি আইটেম নিয়ে ১০-১২ দিন ছক্কা–পাঞ্জা করতে পারলে বড় বড় ডিলারের পক্ষে শতকোটি টাকা কামিয়ে নেওয়া যে ঘটনাই নয়, তা আন্দাজ করা যায়। আদাকাণ্ডের মতো বড় বড় লঙ্কাকাণ্ডের পেছনে যাঁরা থাকেন, সেই ‘ভাশুর’দের নাম মুখে নিয়ে কে–ইবা পদে পদে বিপদ ডেকে আনতে চায়।
আমদানি ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য আন্ডার ইনভয়েসিং করা একটা ওপেন সিক্রেট কৌশল। যে মালের দাম ১০০০ টাকা, সেই মালের দাম সরকারি খাতায় ১০০ টাকা দেখিয়ে একদিকে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া হয়, অপর দিকে সেই মাল এনে খুচরা বাজারে দেড় হাজার টাকা বা তারও বেশি দামে বেচা হয়। মানে ব্যবসায়ীদের কেনায়ও লাভ, বেচায়ও লাভ। ক্ষতি শুধু বাংলাদেশের।
একবার চাল, একবার ডাল, একবার মরিচ, একবার পেঁয়াজ, একবার আণ্ডা, একবার মুরগি, একবার নুন, একবার বেগুন, একবার তেল, একবার জেল—এই সব নিয়ে অনন্তকালীন পর্বের ধারাবাহিক অশ্রুসজল সামাজিক যাত্রাপালা চলতেই থাকবে। পাবলিক বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়লে নাটকে মাঝেমধ্যে কিছু কমেডি দৃশ্য রাখা হবে। খরচের চাপে চ্যাপা শুঁটকি হয়ে যাওয়া দর্শক–শ্রোতাকে দু–একজন ভাঁড় এসে দু–চারটে চুটকি শুনিয়ে যাবেন
দাম বাড়া নিয়ে দু–চার দিন নিউজ-টিউজ হলে নজরদারি কর্তৃপক্ষ আদা–জল খেয়ে মাঠে নামার ছল করে। পরে অনেক জল ঘোলা করে ধীরে ধীরে ফিউজ হয়ে যায়। ফলে আদা-জল খেয়ে মূলত মল ছাড়া কোনো ফল মেলে না।
একটা ব্যাপার এত দিনে পরিষ্কার হয়েছে। সেটা হলো, আমাদের বাজার হলো ভাগাড়। কাস্টমার হলো মরা গরু-গাধা। এখানে চিল, শিয়াল, শকুন, যার যেমন ইচ্ছা, খাবলা দিয়ে মাংস তুলে খাবে। যার জোর যত বেশি, সে তত পাবে।
একবার চাল, একবার ডাল, একবার মরিচ, একবার পেঁয়াজ, একবার আণ্ডা, একবার মুরগি, একবার নুন, একবার বেগুন, একবার তেল, একবার জেল—এই সব নিয়ে অনন্তকালীন পর্বের ধারাবাহিক অশ্রুসজল সামাজিক যাত্রাপালা চলতেই থাকবে। পাবলিক বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়লে নাটকে মাঝেমধ্যে কিছু কমেডি দৃশ্য রাখা হবে। খরচের চাপে চ্যাপা শুঁটকি হয়ে যাওয়া দর্শক–শ্রোতাকে দু–একজন ভাঁড় এসে দু–চারটে চুটকি শুনিয়ে যাবেন।
এখন চলছে পূর্ণদৈর্ঘ্য আদা-নাটক। নাটকের পরিচালনা ও প্রযোজনায় যাঁরা আছেন, তাঁদের ‘নাম বললে চাকরি থাকবে না’। তাই আধপেট খেয়ে ভরপেটের ঢেকুর তোলা গাধা পাবলিক এই নাটকের চিত্রনাট্যে ধাঁধায় পড়ে গেছে।
● সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক