চেনা-অচেনা নির্বিশেষে বড়দের শ্রদ্ধা করা, নারীদের সম্মান করা আমাদের এই অঞ্চলের সামাজিক ঐতিহ্যের অংশ। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির প্রভাবে আরও অনেক কিছুর মতোই অনেক স্থানীয় সামাজিক প্রভাব হ্রাস পেয়েছে, তবে সাধারণভাবেই এই সব আচরণকেও এখনো রীতি হিসেবে দেখা হয়।
অবশ্য সমাজের শাসন ঢিলে হয়ে যাওয়ায় এই জায়গা নিয়েছে সরকার ও বাজার। আধুনিক রাষ্ট্রে প্রতিটি সরকার তাঁর জনগণের সঙ্গে যে প্রধান অলিখিত চুক্তি করে তা হচ্ছে, প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা এবং সম্মান নিশ্চিত করা। আপাতভাবে প্রায় অসম্ভব শোনালেও, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একদম প্রাথমিক আলাপই হচ্ছে এই। যে কারণে দেখা যাবে, আধুনিক দুনিয়ায় কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের গাফিলতিতে একজনের প্রাণ বা মানের হানি হলে তা নিয়ে বড়সড় শোরগোল হয়। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভূরি ভূরি উদাহরণ পাওয়া যায় এমন ঘটনায় কর্তৃপক্ষের ক্ষমা চাওয়া এবং পদত্যাগ করার।
অর্থাৎ জবাবদিহি হচ্ছে সরকার ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কের প্রধান শর্ত। এর জেরেই সরকার বা কর্তৃপক্ষ নানা ধরনের কার্যকলাপের বৈধতা পায়। যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্র রাখার অধিকার, গ্রেপ্তার করার অধিকার, নাগরিকের আয়ের ওপর কর ধার্য করার অধিকার।
এসব প্রাথমিক আলাপগুলো করা হলো সম্প্রতি ঢাকার শাহবাগে জাদুঘরের সামনে বিশিষ্ট পানিবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদ ইনামুল হককে অযাচিতভাবে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের একজন নেতা লাঞ্ছিত করায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, সুষ্ঠু নির্বাচন ও নির্বাচনব্যবস্থার দাবিতে লিফলেট বিতরণ করার সময় এই বর্ষীয়ান মানুষটিকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ব্যক্তি এসে চড় মারেন। সরকারের সমালোচনা করায় এমন মারমুখী আচরণ করেন কৃষক লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের ওই নেতা, যিনি ঢাকায় এসেছিলেন আওয়ামী লীগের সম্মেলনে।
শুধু তা-ই নয়, এই অপমান হজম করে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন ইনামুল সাহেব। তাঁর অভিব্যক্তিতে বোঝা যাচ্ছিল বিস্মিত হলেও তাঁর অবচেতন মন বলছিল, এই দেশে এখন এই সব নৈমিত্তিক ঘটনা। ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়া যায়, যখন তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন যে, উনি এর বিচার চাইতে যাবেন না, কারণ এই দেশে বিচার হয় না।
একজন বিশিষ্ট নাগরিকের এই মন্তব্যটা এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। তিনি নিশ্চিতভাবেই ধরে নিয়েছেন এই দেশে নাগরিকের সম্মান রক্ষার যে জবাবদিহি, কর্তৃপক্ষ সে ব্যাপারে উদাসীন। অর্থাৎ নাগরিক আর সরকারের মধ্যে একদম প্রাথমিক শর্তটাই লঙ্ঘিত হচ্ছে।
ইনামুল সাহেব না হয় অখ্যাত, অজ্ঞাত কেউ হলেও এই আলোচনার গুরুত্ব একই থাকত, কিন্তু শাহবাগের মতো জায়গায় এ রকম একজন প্রবীণ লোকের সঙ্গে এই আচরণ শুধু দুঃখজনকই না, অতিমাত্রায় লজ্জাজনকও। ইনামুল হক সর্বজন বিপ্লবী দলের আহবায়ক। দলটি ছোট হতে পারে বা কম পরিচিত হতে পারে কিন্তু তিনি একজন রাজনৈতিক নেতাই। এখন একজন রাজনৈতিক নেতা শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর নিজের দলের কর্মসূচীও চালাতে পারবেন না?
পূর্ণ গণতন্ত্র বা জবাবদিহি প্রদর্শন প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার, ফলে দেখা যায় ওপরের দিকে ক্ষমতা চর্চা এবং থোড়াই কেয়ার করার একটা প্রবণতা থাকে। আমরা এই তল্লাটের বিভিন্ন নাটক-সিনেমায় দেখতে পাই অনেক মন্ত্রী, এমপিরা কাউকে পরোয়া করেন না। ক্ষমতার জোরে তাঁরা অন্য মানুষের ওপর অন্যায় করেন, সম্মানহানি করেন, তাঁদের মতামতকে গুঁড়িয়ে দেন।
কিন্তু সিনেমায় সেসব দেখানো হয় একটা ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরতে। দর্শক এসব দেখে ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং অপমানিত নাগরিকের যন্ত্রণা বুঝতে পারেন। এমনকি সিনেমাতেও এই চিত্রনাট্য লেখা দুরূহ যে একজন ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা শাহবাগের মতো সদা পাদপ্রদীপের আলোয় থাকা এক স্থানে এসে একজন বয়স্ক নাগরিককে প্রহার করবেন।
সেই নেতাটিও অপমানিত জনের মতোই মনের গভীরে জানেন যে তিনি যা-ই করুন না কেন, এর বিচার হবে না। অবচেতনভাবেই তিনি জবাবদিহি প্রদর্শনের পরোয়া করেন না। কোনোভাবে সরকার বা সরকারি দলের সঙ্গে জড়িত থাকলে বা ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত থাকলে তিনি মোটামুটি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। নিশ্চিতভাবেই ওনার মতো নেতারা সর্বদা, সর্ব স্থানে এই চর্চা করে বেড়ান।
সোজা বাংলায়, গণমনস্তত্ত্বে এখন জবাবদিহি প্রদর্শনের ব্যাপারটি প্রায় উঠে গেছে। রাষ্ট্র ও সমাজের সঙ্গে নাগরিকের মূল বন্ধনটাই ভেঙে পড়ার জোগাড়।
কিন্তু এই অবস্থা মেরামতে সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার হচ্ছে জবাবদিহি প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। জিঘাংসা কিংবা ক্রোধ নয়।
শাহবাগের ঘটনায় দোষী ব্যক্তির পরিচয় জানার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে আলোড়ন পড়ে গেছে। অপমানিত সহনাগরিকদের কেউ কেউ ওই ব্যক্তিকে থাপ্পড় দিতে চাইছেন, কেউ কেউ আরও কঠোর শারীরিক শাস্তিরও দাবি জানাচ্ছেন। অপমানিত মানুষের এমন প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক না। কিন্তু এতে আসলে হিতে বিপরীতটাই হয়। গোড়ার সমস্যাটা মেটে না। সমাজ আরও জিঘাংসু হয়ে ওঠে, জবাবদিহি প্রদর্শন আরও কমতে থাকে।
গ্রামসির হেজিমনি তত্ত্বের আলোকে বলা যায়, সমস্যাটা ব্যক্তির নয়, বরং নিজেকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে ভাবায়। যে ব্যক্তিটি শাহবাগে জঘন্য কাজটি করেছেন, তিনি যদি ক্ষমা চান এবং ওনার যদি চরম সাজাও হয়, তাতে হয়তো জনতার ক্ষণিকের ক্রোধ উপশম হবে, কিন্তু সমস্যা মিটবে না।
আমরা বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের বেলায় এ ঘটনা দেখতে পাই। জনতার জিঘাংসা কী ভয়াবহ হতে পারে, তার ফলাফল দেখি ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মরে যাওয়া অসহায় মা রেনুর বেলায়। চোখের বদলে চোখ তোলার নেশা গোটা দুনিয়াকে অন্ধ করে দেয়।
আবরারের হত্যাকাণ্ডের পর আমরা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সীমাহীন ক্ষমতা প্রয়োগের রাশ টেনে ধরা দেখতে পাইনি। ক্ষমতাসীনদের মনস্তত্ত্বে জবাবদিহি নিশ্চিত করার লেশমাত্র বেড়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সে ঘটনায় কার ফাঁসি হলো, কার যাবজ্জীবন হলো, এর চেয়েও বেশি জরুরি ছিল, জনতা আর ক্ষমতার মধ্যকার সম্পর্কে জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এর উল্টোটা ক্ষমতার বৈধতাকে প্রশ্ন করে।
একজন সহনাগরিকের মতামত পছন্দ হয়নি বলে তাঁর গায়ে অবলীলায় হাত তোলা যায়, এই ধারণাটা যখন রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ছড়িয়ে যায়, তখন রাষ্ট্র গঠনের মূল বিষয়টি কি প্রশ্নবিদ্ধ হয় না?
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক। ইমেইল: [email protected]