গত এক সপ্তাহে পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তিত হয়েছে। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর ইমরান খান (যিনি বিশ্বাস করেন, তাঁকে আটক করা হতে পারে, জেলে ঢোকানো হতে পারে, এমনকি হত্যাও করা হতে পারে) বলেছেন, ‘লন্ডন পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে’; এখন সেনাবাহিনী ‘নিজেই বিচারক, নিজেই উকিল ও নিজেই জল্লাদের’ ভূমিকা নিয়েছে। তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তারা এখন তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে কমপক্ষে ১০ বছরের জন্য জেলে ঢোকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
‘লন্ডন পরিকল্পনা’ বলে ইমরান খান স্পষ্টতই লন্ডনে বসবাসরত নওয়াজ শরিফের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তাঁর মতে, নওয়াজ শরিফই তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার মূল পরিকল্পনাকারী এবং ইতিমধ্যে নওয়াজের ছোট ভাই ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ তাঁকে (ইমরান খানকে) ও তাঁর দল পিটিআইকে নিশ্চিহ্ন করতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
তবে ইমরান খানকে উৎখাত করতে ২০২০ সালে তৎকালীন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে যে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) জোট গঠিত হয়েছিল, তাতে ইতিমধ্যে ভাঙন ধরেছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের এপ্রিলে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ ও তা পাস করার মাধ্যমে এই জোট ইমরানকে সরিয়ে দিয়েছিল। তখন থেকে পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) পাকিস্তান পিপলস পার্টির জোট ক্ষমতা গ্রহণ করে।
পিডিএমের শরিক নেতা মাওলানা ফজলুর রহমান ইমরানের জামিন দেওয়া রায়ের প্রতিক্রিয়ায় চলতি সপ্তাহেই সুপ্রিম কোর্টের বাইরে অবস্থান ধর্মঘটে বসার প্রস্তুতি নিয়েছেন। ফজলুর রহমানের বিশ্বাস, সুপ্রিম কোর্ট ইমরান খানকে জামিন দেওয়ার ব্যাপারে অতি উৎসাহী ভূমিকা নিয়েছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এখন জোটের শরিক নেতা ফজলুর রহমানের অবস্থান কর্মসূচির ভেন্যু সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে অন্যত্র সরানোর চেষ্টা করছেন। তিনি মনে করছেন, ইমরান ও তাঁর সমর্থকেরা পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের জন্য সুপ্রিম কোর্টে হাজির হলে তখন দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
সেনাপ্রধান সম্ভবত মনে করছেন, ইমরান ভোটে দাঁড়ালেই জিতে যাবেন। তখন ইমরান তাঁকে সরিয়ে দিতে পারেন। এ কারণে তিনি সেনাদের মাঠে নামিয়ে পিটিআই কর্মী-সমর্থকদের গণহারে আটক করতে পারেন। কিন্তু সেটি করলে সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়তে হবে, যা আরও বড় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
এদিকে ইমরান খান শুধু তাঁর দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশেই নয়, গোটা জাতির উদ্দেশে কথা বলা শুরু করেছেন। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণগুলোতে তিনি বারবার ইতিহাস ও ধর্ম প্রসঙ্গ আনছেন এবং সেনাবাহিনীর দমন–পীড়নের পাকিস্তানে আরেকটি ভাঙন দেখা দিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। তিনি আবেগঘন ভাষণে পাকিস্তানিদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালাতে বলছেন। তিনি বারবার পাকিস্তানিদের আল্লাহ ছাড়া কারও প্রতি মাথা না নোয়াতে এবং সেনাবাহিনীকে ‘অনৈসলামিক আচরণের’ মাধ্যমে হুমকি দেওয়া প্রতিহত করতে আহ্বান জানিয়েছেন।
ইমরান প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর সমালোচনা এড়িয়ে কেবল সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনীরকে নিশানা করে আক্রমণ করছেন এবং বিচার বিভাগের সমর্থন চাইছেন। সেনাবাহিনীর দমন–পীড়নের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়া এবং একপর্যায়ে পাকিস্তান স্থায়ীভাবে ভেঙে যাওয়ার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
অতীতের পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীদের দিকে তাকালে দেখব, তাঁদের মধ্য থেকে নওয়াজ শরিফ ও বেনজির ভুট্টো—এই দুজন নির্বাসিত হয়েছিলেন এবং শেষোক্তজন দেশে ফেরার পর গুলিতে নিহত হন। তারও অনেক আগে আরেকজন জনপ্রিয় নেতা ও বেনজিরের বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বিতর্কিত বিচারের রায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এর সব কটি ঘটনায় সেনাবাহিনীর হাত ছিল। এমনকি খোদ ইমরান খানের গদিতে বসার পেছনেও সেনা কর্মকর্তাদের ভূমিকা ছিল। ২০১৮ সালে নওয়াজ ভোটে দাঁড়ানোর অযোগ্য বলে ঘোষিত হওয়ার পর ইমরান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন।
কিন্তু ইমরানের আটকের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও সেনা কর্মকর্তাদের বাসভবন ভাঙচুর করা থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টে ইমরানের জামিন পাওয়া ও তাঁকে গ্রেপ্তার না করতে নির্দেশ দেওয়াসহ যা কিছু এখন পাকিস্তানে ঘটছে, তা দেখে সেনাবাহিনীর হাতের মুঠোয় আগের মতো ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে আছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
লাহোরে কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফাইয়াজ গনির বাসভবনে যে হামলা হয়েছে, সে বিষয়ে কি সেনাবাহিনীর কেউ আগেভাগে কিছু জানতেন না? নাকি জেনারেলদের অনেকেই সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে জনক্ষোভ বিস্ফোরিত হওয়ার পক্ষে ছিলেন? এসব প্রশ্ন এখন উঠতে শুরু করেছে। পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের জন্য পরপর দুটি তারিখ ঘোষণা করা হলো। দুটি তারিখই পার হয়ে গেল। নির্বাচন হলো না। এটি কি সরকার ও সেনাবাহিনীর অসামর্থ্য প্রকাশ করে না?
আগামী অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। আর ইমরানের এখন যে জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে, তাতে সেই নির্বাচনে তিনি দাঁড়ালে তাঁর জয় প্রায় নিশ্চিত। এ কারণে ক্ষমতাসীন জোট ও সামরিক বাহিনীর, বিশেষ করে সেনাপ্রধান অসীম মুনিরের ইমরান খান নিয়ে মাথাব্যথা আছে। আগামী আগস্টেই এই সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে এবং মেয়াদ পূরণের আগেই পার্লামেন্ট ভেঙে দিলে সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। তার মানে নির্বাচন এখন থেকে অক্টোবরের যেকোনো সময়ই হতে পারে। ফলে নির্বাচন বিষয়ে সেনাবাহিনীর হাতে সময় কম।
সেনাপ্রধান সম্ভবত মনে করছেন, ইমরান ভোটে দাঁড়ালেই জিতে যাবেন। তখন ইমরান তাঁকে সরিয়ে দিতে পারেন। এ কারণে তিনি সেনাদের মাঠে নামিয়ে পিটিআই কর্মী-সমর্থকদের গণহারে আটক করতে পারেন। কিন্তু সেটি করলে সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়তে হবে, যা আরও বড় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
এখন ইমরান খানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে সেনাবাহিনী সেই সংকট মোকাবিলার ঝুঁকি নেবে কি না, সেটা বুঝতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● শরণ সিং দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিভাগের কূটনীতি ও নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ের অধ্যাপক