এবারের বইমেলা ছিল বেশ ঘটনাবহুল। মেলায় আদর্শর মতো প্রতিশ্রুতিশীল একটি প্রকাশনী সংস্থাকে স্টল দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া একাধিক লেখকের বই ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়। এসব কারণে মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিষয়গুলো নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বেশ আলোচনা–সমালোচনা হয়। আদর্শকে স্টল না দেওয়ার ঘটনায় প্রকাশক মো. মাহাবুবুর রহমান একটি রিট করলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্ট আদর্শকে স্টল বরাদ্দ দেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু আপিল বিভাগে সেই আদেশ স্থগিত হয়ে যায়।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, আদর্শকে স্টল না দেওয়ার বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অনেকেই সরব ছিলেন; তাঁরা পত্রপত্রিকায় লিখেছেন, গণমাধ্যমে বক্তব্যও দিয়েছেন। কিন্তু আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তে স্টল বরাদ্দের আদেশ স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর এটা নিয়ে কেউ তেমন কোনো কথা বলেননি। এই নীরবতার কারণ এটা নয় যে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁরা তাঁদের অবস্থান বদল করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই নীরবতার কারণ হলো আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত হওয়ার ‘ভীতি’ বা ‘আতঙ্ক’। আদালতের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে কেউ কিছু বললে বা লিখলে তিনি কি সত্যিই আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত হবেন? এই প্রশ্নের উত্তর কী হবে, তা এখন আদালতের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে এ প্রসঙ্গে কয়েকজন স্মরণীয় ব্যক্তির বক্তব্য উল্লেখ না করে পারছি না।
প্রথমেই সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে স্মরণ করি। তিনি লিখেছেন, ‘কোনো বিচারকই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। সভ্য জগতে ভব্য সমালোচনার একটা অবকাশ রয়েছে। বিচারকের রায়ের সমালোচনা করার অধিকার বাক্স্বাধীনতার এক অংশ বলে আমি মনে করি। আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সংবিধানে এই বাক্স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। এই মৌলিক অধিকারের আলোকে আমাদের আদালত অবমাননার আইন সংশোধন প্রয়োজন।…’ (প্রজাতন্ত্রের বিচারশক্তি ও জনগণের অধিকার, আইনবিষয়ক প্রবন্ধাবলী, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান)
আরেকজন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান সংবাদমাধ্যমে বিচারকদের সমালোচনার বিষয়ে বেশ সহজভাবে কিছু কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বিচারকদের কর্মকাণ্ড ও তাঁদের আচরণের ওপর নজর রাখার ক্ষেত্রে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, সংবাদপত্র বিচারকদের কর্মকাণ্ডের সতর্ক প্রহরী (ওয়াচ ডগ)।…বিচারকগণও মানুষ এবং এ কারণেই তাঁরা ভুলের ঊর্ধ্বে নন। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণও রায় প্রদানে ভুল করতে পারেন। সে দিক থেকে একজন বিচারক আন্তরিক ও ন্যায়সঙ্গত সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন।…’ (বিচারকদের জবাবদিহিতা, আলোকিত প্রত্যাশা, বিচারপতি লতিফুর রহমান)
আদালতের সিদ্ধান্ত যুক্তিসংগত মনে না হওয়ায় ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো সমালোচনায় মুখর হয়েছিল। এ রকম তীব্র ও বিদ্রূপাত্মক সমালোচনার পরও সেখানে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটা হলে কী হতো, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। আদর্শর ঘটনায় আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো আলোচনা–সমালোচনা না হওয়া একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র।
অনেকেই মনে করেন, বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে কিছু বলা বা লেখা আদালত অবমাননা। আসলেই কি তাই? এ বিষয়ে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী মাদ্রাজ হাইকোর্টের হনুমন্থ রাও বনাম পত্তাভিরাম মামলার রায়ের কথা উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘...প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি মনে রাখতে হবে। তা ছাড়া অবশ্যই মনে রাখতে হবে একটি ন্যায্য বিচারে মামলারত ব্যক্তিদের স্বার্থ ছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ থাকতে পারে। সেটা হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থের ভারসাম্য–রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে জনস্বার্থের উপস্থিতি এবং সেখানে জনস্বার্থ মুখ্য বিধায় আদালতের রায়ের পূর্বে ও পরে ন্যায্য আলোচনা ও মন্তব্য অবশ্যই অনুমোদনযোগ্য।’ (আদালত অবমাননার পারিভাষিক অর্থ, বাংলাদেশের দুঃখের বিচার, মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী)
বিচারপতি লতিফুর রহমানের তাঁর প্রবন্ধে ইংল্যান্ডে স্পাইকেচার নামে একটি বই নিয়ে মামলার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘...স্পাইকেচার মামলা একটি বিখ্যাত মামলা। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সার্ভিসের সাবেক সদস্য মিস্টার পিটার রাইট এ বইটি লেখেন এবং আমেরিকায় বইটি প্রকাশ করা হয়। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায়ও বইটি প্রকাশের চেষ্টা চালানো হয়। ব্রিটিশ সরকার উভয় দেশে বইটির প্রকাশনা বন্ধের জন্য মামলা করে। ইংল্যান্ডে আপিল আদালত সীমিত আলাপ–আলোচনামূলক নিষেধাজ্ঞা তুলে না নিয়ে বরং তার মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দেয়। এতে দ্য লন্ডন টাইমস–এ কড়া সমালোচনা করে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়। সম্পাদকীয়তে বলা হয়, গতকাল সকালে আইনটিকে সোজা কথায় গাধার মতো দেখাচ্ছিল…কিন্তু বিকেলেও আইনটি গাধাই থেকে গেল! লন্ডনের ডেইলি মিরর–এর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘‘আহাম্মকের দল’’ শিরোনামে হাউস অব লর্ডসের তিন ল লর্ডের ছবি ছাপা হয় উল্টাভাবে। কিন্তু এত তীব্র ও বিদ্রূপাত্মক সমালোচনা সত্ত্বেও আদালত অবমাননার কোন অভিযোগ আনা হয়নি কিংবা কোন ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি।…’ (বিচারকদের জবাবদিহিতা, আলোকিত প্রত্যাশা, বিচারপতি লতিফুর রহমান)
ওপরে বর্ণিত মামলাটা যেহেতু বই নিয়ে, তাই এর সঙ্গে আদর্শর ঘটনায় আমাদের আদালত ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে দেখা যেতে পারে। আদালতের সিদ্ধান্ত যুক্তিসংগত মনে না হওয়ায় ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো সমালোচনায় মুখর হয়েছিল। এ রকম তীব্র ও বিদ্রূপাত্মক সমালোচনার পরও সেখানে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটা হলে কী হতো, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। আদর্শর ঘটনায় আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো আলোচনা–সমালোচনা না হওয়া একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র। এ রকম আরও বহু ঘটনায় আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত হওয়ার ‘ভীতি’ বা ‘আতঙ্ক’ থেকে অনেকেই ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আরোপে বাধ্য হয়েছেন এবং হচ্ছেন, এ সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
মনজরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক