হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার জন্য যা ঘটছে, তাকে কোনো আচমকা ঘটনা বলা যাবে না। এ ঘটনাকে গাজায় হামাসকে পরাজিত করার জন্য ইসরায়েলি চেষ্টার সঙ্গে মেলানো ঠিক হবে না। হিজবুল্লাহ ও ইরান ‘কৌশলগত ধৈর্য’ ধরার তথা তাদের নেতাদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের প্রতিক্রিয়া না দেখানোর যে পথ অবলম্বন করেছিল, সেটিকেই ইসরায়েল কাজে লাগিয়েছে। ২০০৮ সালে হিজবুল্লাহর সামরিক শাখার নেতা ইমাদ মুগনিয়েহের হত্যার প্রতিশোধ সংগঠনটি নেয়নি। এ বছর বৈরুতের দাহিয়ায় হামাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সালেহ আল-আরৌরির হত্যার প্রতিক্রিয়ায় তারা কিছু করেনি। হিজবুল্লাহ ও ইরানের এসব দুর্বল প্রতিক্রিয়া ইসরায়েলকে আরও বেশি আক্রমণ চালানোর আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।
ইসরায়েল যতবারই আক্রমণ করেছে, ততবারই হিজবুল্লাহ ও ইরান বলেছে, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। তারা বলেছে, তারা গাজায় হামাসের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য হামাসকে সহায়তা করছে এবং যুদ্ধবিরতি হলেই তারা সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেবে। হিজবুল্লাহ যখন শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলকে আঘাত করেছে, তখনো তারা শুধু ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের নিশানা করেনি।
হিজবুল্লাহর কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়েছে, তাদের রকেট ও প্রচারণার ভিডিওগুলো মূলত তাদের ক্ষমতা দেখাতে তৈরি হয়েছে, ব্যবহারের জন্য নয়। ‘ধৈর্য ধারণের’ এই কৌশল কৌশলগতভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এই ভুল কৌশলের জন্য হিজবুল্লাহকে এখন মূল্য দিতে হচ্ছে। কারণ, এটি ইসরায়েলকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে এবং সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই তারা এখন লেবাননে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।
ইরানের সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তাঁকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে তাঁকে জানানো হয়েছিল, যদি ইরান হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়ার হত্যার প্রতিক্রিয়া না জানায়, তাহলে গাজায় যুদ্ধবিরতি হবে। শেষ পর্যন্ত ইরানের ‘কৌশলগত সংযম’ ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গত মঙ্গলবার রাতে ইরানের দিক থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে ১৮০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়।
এই হামলার পরও পেজেশকিয়ান বলেছেন, ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায় না, তবে তেহরান তার সংযমের নীতি বাদ দিয়েছে। এ অবস্থায় হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেন ও ইরাকের সশস্ত্র গ্রুপগুলো এখন আগের চেয়ে সক্রিয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে পাল্টা হামলার দিকে গিয়ে ইসরায়েল আরও বড় ভুল করছে। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। এ অবস্থার মধ্যে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশকে নিজেদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে। অসলো চুক্তির পর থেকে গত তিন দশকে আরব বিশ্বে ফিলিস্তিনের সমস্যা গুরুত্ব হারিয়েছিল। এই সময়টাতে ফিলিস্তিন ইস্যু আরব বিশ্বে অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল।
আরব বসন্তের পর পাল্টা বিপ্লবে আরব বিশ্বের মধ্যে যে বিভক্তি তৈরি হয়েছিল, ইসরায়েলের এই অবাধ আক্রমণ সেই বিভক্তি সারিয়ে তুলছে। আপনি যখন নাসরুল্লাহকে হত্যার জন্য ৮০ টন বোমা ফেলেন এবং এরপর নির্বিচার তিন শ জনকে হত্যা করেন, তখন আপনি তাঁকে প্রতিরোধের প্রতীক থেকে এক কিংবদন্তিতে পরিণত করে ফেলেন। লেবাননের রাজনীতিবিদ সুলেইমান ফ্রানজিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রতীক চলে গেলে কিংবদন্তি জন্ম নেয় এবং প্রতিরোধ চলতে থাকে।’
অবশ্য আরব শাসকশ্রেণি এবং সেখানকার অভিজাত গোষ্ঠী (যাদের অধিকাংশের লেনদেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে এবং তার সুবাদে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সখ্য তৈরি হয়েছে) নাসরুল্লাহকে ততটা মহান হিসেবে দেখে না। তবে তারাও এখন তাদের সাধারণ মানুষের আবেগকে আমলে নিতে বাধ্য হচ্ছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ওয়াশিংটনের গুরুত্ব পাওয়ার পথ হিসেবে ইসরায়েলকে ব্যবহার করেছেন। তবে তিনিও একজন নেতা হিসেবে তাঁর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে খোলাখুলি বলেছেন। চলতি বছরের গোড়ার দুই ব্যক্তির একটি কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, এটি মোহাম্মাদ বিন সালমান ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের কথোপকথন। সেখানে যে কণ্ঠটিকে মোহাম্মাদ বিন সালমানের বলে মনে করা হচ্ছিল, সে কণ্ঠটিকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ আমার চেয়ে কম বয়সী। তাদের অধিকাংশই ফিলিস্তিন সমস্যার বিষয়ে তেমন কিছু জানে না। তারা প্রথমবারের মতো এই সংঘাতের মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যা সম্পর্কে জানছে। এটি একটি বড় সমস্যা। ব্যক্তিগতভাবে আমি কি ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন? আমার জবাব হলো “না’; কিন্তু আমার জনগণ উদ্বিগ্ন, তাই আমাকে এটি তাদের কাছে নিশ্চিত করতে হবে, ফিলিস্তিন সমস্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।’
একজন সৌদি কর্মকর্তা কথোপকথনটিকে মোহাম্মদ বিন সালমান ও ব্লিঙ্কেনের নয় বলে দাবি করলেও সেটিকে আসল বলে বেশির ভাগ লোক মনে করেন। হ্যাঁ, ইসরায়েল যে পুরো আরব ভূখণ্ডকে তার নিজের মতো করে গড়ে তোলার জন্য বেপরোয়া ও মরিয়া হয়ে উঠেছে, তাতে সন্দেহ নেই। ইসরায়েল এমন এক পথ বেছে নিয়েছে, যা খ্রিষ্টান ও শিয়া-সুন্নি মুসলমানদের সমানভাবে লক্ষ্যবস্তু করছে এবং ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলকে ইসরায়েল যে আপন করে নিচ্ছে না, তা অন্য যেকোনো ইসরায়েলি নেতার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাঁর আচরণ দিয়ে অনেক বেশি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে এর জন্য ইসরায়েলকে গভীর কৌশলগত পরিণতি বরণ করতে হবে।
ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ