বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘খসড়া ডিজিটাল বাণিজ্য আইন, ২০২৩’ তৈরি করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবে এই খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন ও অংশীজনেরা সেটির ওপর মতামত দিয়েছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, খসড়ার ওপর আলোচনায় অংশগ্রহণকারী প্রায় সব শ্রেণির প্রতিনিধি ই-কমার্সের জন্য নতুন কোনো আইনের প্রয়োজন নেই বলে মতামত দিয়েছেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার আমাদের স্কুলে পরিদর্শক এসে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা শুরু করলেন। আমাদের ক্লাসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম কোথায়?’ ক্লাসের অনেকেই জানত চব্বিশ পরগনার পেয়ারা গ্রামে। কিন্তু আমাদের যে সহপাঠীকে প্রথমে জিজ্ঞেস করা হলো, সে আমতা-আমতা করে উত্তর দিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম ঢাকায়। পরিদর্শক মহাশয় সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘ভেরি গুড’!
এরপর একে একে ক্লাসের সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন। বাকি সবাই, এমনকি যাদের উত্তর জানা ছিল, তারাও বলতে থাকল ‘ঢাকা, ঢাকা’! তিনিও ‘ভেরি গুড’, ‘ভেরি গুড’ করতে লাগলেন। আশা করি, এই ‘ভেরি গুড’ শোনার আশায়, সবার মুখ থেকে ‘নতুন আইন প্রয়োজন নেই’ বেরিয়ে আসেনি। খাতসংশ্লিষ্টরা যেহেতু বলছেন আইনের প্রয়োজন নেই, সেহেতু ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।
তবে ‘কী’ প্রয়োজন নেই, সেটির চেয়ে ‘কেন’ প্রয়োজন নেই, সে ব্যাখ্যাটুকু গণমাধ্যমগুলোতে আরেকটু বেশি এলে, অন্যদের কাছে ব্যাপারগুলো পরিষ্কার হতো। সারা বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্য বা ‘কমার্স’ নতুন না হলেও ‘ই-কমার্স’ নতুন। আগে অনলাইন পেমেন্ট বা ট্র্যাকিং বলে কিছু ছিল না। ওয়েবসাইটে পণ্য এক রকম, কিন্তু ডেলিভারির পর অন্য রকম দেখার সুযোগ ছিল না। পেমেন্ট গেটওয়েতে টাকা আটকে থাকার ব্যাপার ছিল না। খুব স্বাভাবিকভাবেই, এ বিষয়গুলো বিদ্যমান আইনে থাকার কথা নয়।
নতুন আইন না করে, পুরোনো বা বিদ্যমান আইনে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব এসেছে। নতুন আইন হচ্ছে, সেটি উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত? নাকি আইনের কী কী ধারা-উপধারা ব্যবসাবান্ধব নয়, সেটি নিয়ে সরব হওয়া উচিত? নতুন আইন না করে, এই ধারাগুলো পরোক্ষভাবে পুরোনো আইনে যোগ করে দিলে কী সমস্যার সমাধান হবে? হতে পারে, আইনগত দিক থেকে চিন্তা করলে এই প্রশ্নগুলোর খুব সহজ উত্তর ও ব্যাখ্যা আছে।
আইন মাকড়সার জালের মতো, ক্ষুদ্র কেউ পড়লে আটকে যায়, বড়রা ঠিকই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। গ্রিসের আইনপ্রণেতা সলোনের সেই বিখ্যাত উক্তির মতো, ‘আমাদের এসব আইনও যেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আটকে ফেলার কলকাঠি না হয়ে যায়।’ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকা, সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতটিকে এখন লালন করার সময়।
আবার ই-কমার্স সেল আছে বিধায় নতুন কর্তৃপক্ষ অপ্রয়োজনীয় বলা হচ্ছে। ই-কমার্স সেলের কি ই–কমার্সসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের ওপর কর্তৃত্ব বা সমন্বয় করার এখতিয়ার আছে? এখতিয়ার না থাকলে, সেই সেল কাজ করবে কী করে? আর এখতিয়ার থাকলে ঘুরেফিরে সেটি তো কিছুটা হলেও সেই কর্তৃপক্ষের মতোই হলো। এখানে আপত্তিটা বরং থাকা উচিত সরকারের পক্ষ থেকে। নতুন কার্যক্রমে সরকারের জটিলতা বাড়বে, খরচ বাড়বে।
ওদিকে খসড়ায় থাকা সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো বড়-ছোট সব প্রতিষ্ঠানকে এক কাতারে ফেলে দেওয়া। শুধু একটা উদাহরণ দিই। সাধারণ একটি ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসাকেও এই আইন কার্যকর হওয়ার চার মাসের মধ্যে নিবন্ধন গ্রহণ করতে হবে। কোটি কোটি টাকার কোম্পানির জন্য যে নিয়ম, চর কুকুরিমুকরি অঞ্চলের ফেসবুকভিত্তিক বুটিক ব্যবসায়ী হাশেম মিয়ার জন্যও একই নিয়ম খাটে? এই হাশেম মিয়া যদি অনলাইন বা ই-কমার্সে না আসে, তাহলে তো তার জন্য নিবন্ধনের কোনো ব্যাপারই নেই। প্রকারান্তরে, এটি ই-কমার্সকে নিরুৎসাহিত করার আয়োজন নয় কি?
অনলাইনে পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা বলা হয়। সেটি কি অফলাইনে হয় না? ৩২ কোমরের প্যান্ট বাসায় গিয়ে কি ৩০ হয়ে যায় না? টকটকে লাল তরমুজ কাটার পর চালকুমড়ার মতো সাদা হয়ে যায় না? খসড়া আইন অনুযায়ী, পণ্যের মান গ্রাহক কর্তৃক গৃহীত না হলে চুক্তিপত্র অনুযায়ী বিক্রেতা পণ্য ও অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে।
অনলাইনে হওয়া লেনদেনের সব দায়িত্ব কি আইনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে? ভোক্তা বা ক্রেতাদেরও কি দায়িত্ব নেই? নিউমার্কেটের বিশাল বড় রুই মাছ কেনার পর, সেটি পচা হলে, টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য কি আইন করে ফেলা হয়? এগুলো অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যক্রম, সবাই এসব থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু সবকিছু একেবারে আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কী মাত্রায় কতটুকু আইনে আসবে, সেটির শাস্তিই–বা কতটুকু হবে, প্রথমেই শাস্তি দিয়ে ফেলতে হবে, নাকি আগে সতর্কতা জারিমূলক পদক্ষেপ হবে, এসব অনেক বিবেচ্য বিষয় আছে।
আইন মাকড়সার জালের মতো, ক্ষুদ্র কেউ পড়লে আটকে যায়, বড়রা ঠিকই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। গ্রিসের আইনপ্রণেতা সলোনের সেই বিখ্যাত উক্তির মতো, ‘আমাদের এসব আইনও যেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আটকে ফেলার কলকাঠি না হয়ে যায়।’ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকা, সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতটিকে এখন লালন করার সময়।
এখনো দেশের ৫ শতাংশ মানুষও ই-কমার্সের আওতায় আসেনি, যেখানে চীনে এসেছে এক–চতুর্থাংশ মানুষ। অনেক ক্ষেত্রে আমরা কর্তৃপক্ষকে বলতে শুনি, আমরা সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আলোচনা হয়তো তাঁরা করেনও, কিন্তু আলোচনা শেষে নিজের খুশিমতো সিদ্ধান্ত লিখে ফেললে তো হলো না। ‘আলোচনা করে (নিজের মতো) সিদ্ধান্ত নেওয়া’ আর ‘আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া’—এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক।
ড. বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়