কুড়িগ্রামের চিলমারীর পণ্ডিত বইমেলা বাংলাদেশের সব জাতিসত্তার বইমেলায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনার বীজ আছে। সারা দেশ থেকে লেখক-শিল্পীরা আসছেন। গ্রামের লেখকেরাও যে জাতীয় ও বিশ্বসাহিত্যের অংশ, এই বোধ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। অন্যান্য জাতিসত্তার নেতাদের আয়োজক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বইমেলাটিতে তাঁরা যেন ভূমিকা রাখতে পারেন।
পাণ্ডিত্যময় সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা হলো এই বইমেলার লক্ষ্য। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে এটাই একমাত্র বইমেলা। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু কর্মসূচি থাকে। হাজার পাঁচেক প্রতিযোগী অংশ নেয়। প্রায় ৫০০ জনকে পুরস্কৃত করা হয়। গত পাঁচটি বছর তা–ই হয়েছে। ফলে দেখা যায়, এই বইমেলায় নন–ফিকশন বই ফিকশনের চেয়ে বেশি বিক্রি হয়।
পণ্ডিত বইমেলার উদ্বোধক ছিলেন কবি আনিসুল হক, গল্পকার মঈনুল আহসান সাবের, চিন্তক সলিমুল্লাহ খান ও অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। এবারের উদ্বোধক আবুল হোসেন। ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে চিলমারীতে দাতব্য কাজে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, সারা দুনিয়ায় যোগাযোগ করে কুড়িগ্রাম জেলাব্যাপী টেরেডেস হোমস (মানে পৃথিবীর শিশুরা) গড়ে কয়েক হাজার পরিচয়হীন শিশুকে উদ্ধার করেছেন, খাইয়ে-পড়িয়ে ও কাজ শিখিয়ে তাদেরকে গড়ে তুলেছেন। তারা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত হয়েছেন।
এবারে পাঁচ দিনের পাঁচজন প্রধান অতিথি থাকছেন। তাঁরা হলেন যথাক্রমে কলামিস্ট ও কবি সোহরাব হাসান, ইঞ্জিনিয়ার মতিয়ার রহমান, তরুণ সংসদ সদস্য বিপ্লব হাসান পলাশ, অতিরিক্ত ডিআইজি মেহেদুল করিম ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরিফ। আর সভাপতি হিসেবে থাকবেন যথাক্রমে সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক, অন্যতম সংগঠক সাইদুল আবেদীন ডলার, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রুকুনুজ্জামান শাহীন, রংপুর আইন কলেজের অধ্যক্ষ সাজেদ হোসেন তোতা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজুল ইসলাম। আর প্রতিদিন স্বাগত বক্তৃতা দেবেন আয়োজনের আহ্বায়ক কলামিস্ট নাহিদ হাসান।
উদ্বোধক নির্বাচনে আমাদের স্বাধীনতায় বরাবরই স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসক সানন্দে সম্মতি দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একদল আরেক দলের নেতাদের ডাকায়ও বাধা দেননি। পণ্ডিত বইমেলা যে সমাজের বইমেলা, এটাকে সবাই মেনে নিয়েছেন।
এ ছাড়া লেখকদের বিষয়ভিত্তিক আলোচনার পর্ব থাকে। এবারের পাঁচ দিনের আলোচনার বিষয়গুলো হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিসমূহের বই ও মেলার ভবিষ্যৎ, ভাওয়াইয়ার দাপুটে নারীরা কই গেল?, ঔপনিবেশিক বাংলা ভাষার কর্তৃত্ব কত কাল, ভাষা নির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কি শেষ?
হাজং, সাঁওতাল, গারোসহ কয়েকটি জাতির প্রতিনিধি থাকবেন। তাঁরা বলবেন, গাইবেন। ব্রিটিশ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে জন্ম নেওয়া বাংলা আমাদের প্রাকৃত বাংলা, অংপুরিয়া ভাষা, হাজং, সাঁওতাল, গারো ভাষাকে খেয়ে দিতে চায়। এমনকি ঢাকাইয়া ভাষাও। এই ভাষাগুলোর সাহিত্য দাঁড়ায়নি। এই ভাষাগুলোর বিকাশে পণ্ডিত বইমেলার গুরুত্ব আছে।
কিংবদন্তি ভাওয়াইয়া গানগুলোর কথা ও সুর শুনলেই বোঝা যায় এগুলো লিখেছেন মূলতই নারীরা। কিন্তু কোথাও তাদের নাম নেই। তাদের গানগুলো প্রচলিত নামে প্রচারিত হয়। আব্বাসউদ্দীন, কছিম উদ্দীনের নাম যেভাবে শুনি, সেভাবে প্রতিমা বড়ুয়ার কথা শোনা যায় না।
পণ্ডিত বইমেলা আরও বেশ কিছু কারণে স্বতন্ত্র। এখানে দেড় শতাধিক লেখক–শিল্পী রাতে একসঙ্গে থাকছেন, খাচ্ছেন, সকালে নৌবিহার করছেন, বিকেলে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন আর সন্ধ্যায় গানের আসরে গাইছেন। এবারের আয়োজনে থাকবে কুষান পালা ও ভাওয়াইয়ার আসর। এবার ভাওয়াইয়ার পাশাপাশি সাঁওতাল শিল্পীরা গাইবেন, দলিত রবিদাস শিল্পীরা গাইবেন। তেমনি থাকবে সুকুমার বাউলের গান। গাইবেন ভারতীয় গণসংগীতশিল্পী অসীম গিরি এবং একদিন কবি কামরুজ্জামান কামুর গান ও কবিতার আসর হবে।
পণ্ডিত বইমেলা চিলমারীতে কেন? এটা একটা প্রাচীন নগরী। গানে, কবিতায়, সাহিত্যে চিলমারী পৌরাণিক মূর্তি পেয়েছে। চিলমারীকে নিয়ে বরেন্দ্র, গৌড়, কামরূপ রাজাদের লড়াই হয়েছে। আমেরিকান আর্কিওলজি বিভাগ দেখিয়েছে, রোমান সাম্রাজ্যের আমলেও বাণিজ্যপথ ছিল চিলমারী। অষ্টমীর বা বারুণির মেলা চিলমারীকে তীর্থে পরিণত করেছে হাজার বছর ধরে।
চিলমারীর পর্যটন সম্ভাবনা বিপুল। তাঁরা চিলমারীকে দেখবেন, চিলমারী নিয়ে লিখবেন। এর ফলে চিলমারীতে ব্যবসা–বাণিজ্যের বিকাশ ঘটবে। গরিব জেলা হিসেবে চিলমারীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতেও পণ্ডিত বইমেলা ভূমিকা রাখবে।
নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক
[email protected]