কয়েক দশক ধরে আরব বিশ্ব অনৈক্যের ব্যাধিতে আক্রান্ত। যদিও এই অঞ্চল ভৌগোলিক, ভাষা এবং সংস্কৃতির দিক থেকে পরস্পর সংযুক্ত; তথাপি তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মিলমিশ নেই। সংহতির অভাব বিদেশি শক্তিগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে তাদের সম্পদ লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিয়েছে।
সেই ঔপনিবেশিক আমলের ‘ভাগ কর, শাসন কর’ কৌশলের রেশ এখনো এ অঞ্চলে রয়ে গেছে এবং সংকীর্ণ মনোভাব আরবদের তাদের বিপুল তেল সম্পদ এবং তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত জনসম্পদকে কাজে লাগাতে বাধা দিয়েছে। কিন্তু ফিফা বিশ্বকাপ আমাদের একটি বিকল্প পথ দেখিয়েছে।
চলমান বিশ্বকাপে আরব দেশগুলোর পরপর অপ্রত্যাশিত জয় আরবদের পারস্পরিক বিভেদ ভুলে এক হওয়ার একটি দুর্দান্ত উদ্দীপক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। নভেম্বরে সৌদি আরব আর্জেন্টিনাকে, তিউনিসিয়া ফ্রান্সকে এবং মরক্কো বেলজিয়ামকে পরাজিত করে। তারপর নকআউট পর্বে স্পেন এবং পর্তুগাল উভয়কেই হারিয়ে মরক্কো সেমিফাইনালে জায়গা করা প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইতিহাস তৈরি করেছে।
মরক্কোর কোচ ওয়ালিস রেগরাগুই গোলরক্ষক হিসেবে ইয়াসিন বুনুকে দলের কৌশলের কেন্দ্রে রেখেছিলেন। তাঁর নিখুঁত পরিকল্পনার ফল ছিল মরক্কোর জয়। গোলরক্ষক বুনু বারবার স্পেনের গোল করার চেষ্টাকে ঠেকিয়ে দেন এবং পেনাল্টি শুটআউটে দেশটিকে বিদায় করে দেন। পর্তুগালের আক্রমণকারীরাও বুনুকে পরাস্ত করার কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারেনি এবং কোচ রেগরাগুইয়ের দল ১-০ গোলে অত্যাশ্চর্য জয় তুলে নেয়। একজন ধারাভাষ্যকার বিবিসিকে বলেছেন, ‘বিশ্বকাপে এমন ধাক্কা দর্শক এর আগে কবে দেখেছে, তা ভাবার চেষ্টা করছি।’ বুনু আনন্দের আতিশয্যে বলেছেন, ‘আমার গায়ে চিমটি কাটো, আমি মনে হয় স্বপ্ন দেখছি।’
তবে কিনা দলের সাফল্য আর স্বপ্ন এক জিনিস নয়। মরক্কো প্রথম থেকেই জানত, তারা একটি আন্ডারডগ টিম। ফুটবল খেলায় প্রতিটি খেলোয়াড়ের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি গোল করার জন্য দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ মনোযোগ ও চেষ্টা থাকতে হয়। মরক্কোর খেলোয়াড়েরা দলের প্রতি সেই নিষ্ঠা দেখিয়েছেন এবং পুরো আরব অঞ্চলের মানুষকে তাঁরা অনুপ্রাণিত করেছেন।
মরক্কোর বিজয়ের পরে আরব শিশুরা রাস্তায় নেমে উল্লাস করেছে এবং কাতারে ফুটবল দর্শকদের ও মরক্কোর খেলোয়াড়দের আরব সংহতি প্রদর্শনস্বরূপ ফিলিস্তিনি পতাকা নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। প্রতিটি বিজয়ী আরব দল তাদের গ্রুপ ছবি এবং আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতিসূচক প্রতীক ও শব্দের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছে।
আরবের পরিবারভিত্তিক ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো উন্নতি করতে পারে, কিন্তু আরব করপোরেশনগুলো খুব কদাচিৎই বিশ্ববাণিজ্যে ঝাঁকুনি দিতে পেরেছে। শিগগিরই যে সে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে, এমনটাও মনে হয় না। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, আরব বিশ্বের সফল কোম্পানিগুলোর ৭৫ শতাংশের বেশি হচ্ছে পারিবারিক মালিকানাধীন।
এটি সম্ভবত আর মোটেও আশ্চর্যজনক বিষয় নয় যে স্পেনের লা লিগায় ইতিপূর্বে খেলে আসা গোলরক্ষক বুনু এখন আরব যুবকদের রোল মডেল হয়ে উঠেছেন। দীর্ঘদেহী ও চটপটে বুনুকে তাঁর আত্মবিশ্বাস, নম্রতা এবং নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ আর দশজন খেলোয়াড় থেকে তাঁকে আলাদা করেছে। ফুটবল এমন একটি খেলা, যেখানে সাধারণত তারকারা প্রায়ই অহংকার প্রদর্শন করে থাকেন; কিন্তু ইয়াসিন বুনুর আচরণে বিনয় ফুটে ওঠে।
তবে অহংবোধ গোটা আরব বিশ্বকে ব্যাপকভাবে পিছিয়ে রেখেছে। সংহতিকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে একটি দলের কৌশল ঠিক করা উচিত। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলো সাধারণত খেলাধুলায় এবং জীবনে এ সংহতি প্রদর্শন করতে পারে না। এটি ঠিক যে আলজেরিয়ার তৌফিক মাখলুফি ২০১২ সালের লন্ডন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ১ হাজার ৫০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতেছিলেন; মরক্কোর হিচাম এল গুয়েরুজ ২০০৪ সালে এথেন্সে ১ হাজার ৫০০ মিটার এবং ৫ হাজার মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছিলেন এবং সিরিয়ার ঘাদা শুয়া আটলান্টা গেমসে ১ হাজার ৫০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতেছিলেন। কিন্তু এসব খেলোয়াড় ব্যক্তিগত ইভেন্টে জিতেছেন। যখন দলগত খেলার কথা আসে, তখন আরব দেশগুলো সাধারণত জঘন্যভাবে হেরে যায়।
এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যেও একই ব্যাপার দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আরব বিশ্বে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আরব লিগ তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু আরব দেশগুলোর আন্ত–আরব বাণিজ্যে এখনো তাদের আমদানি-রপ্তানি ১০ শতাংশের কম।
আরবের পরিবারভিত্তিক ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো উন্নতি করতে পারে, কিন্তু আরব করপোরেশনগুলো খুব কদাচিৎই বিশ্ববাণিজ্যে ঝাঁকুনি দিতে পেরেছে। শিগগিরই যে সে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে, এমনটাও মনে হয় না। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, আরব বিশ্বের সফল কোম্পানিগুলোর ৭৫ শতাংশের বেশি হচ্ছে পারিবারিক মালিকানাধীন।
তবে সুসম্পাদিত এবং বাস্তবসম্মত কৌশলের ওপর ভিত্তি করে আরব ঐক্য গঠিত হলে এ অঞ্চলে বিশাল পরিবর্তন আনবে। আর এ ক্ষেত্রে বিশ্বকাপে মরক্কোর ভূমিকা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
দাউদ কাত্তাব মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক