কয়েক দিন আগে অশীতিপর বৃদ্ধ ইউসুফ সরকার বলছিলেন, ‘রংপুর শহর খুব ভালো ছিল। শ্যামাসুন্দরীর পানিও ছিল খুব টলটলা। আমরা এই পানিত গোসল করছি, মাছ ধরছি। সারা বছর পানি থাকত। এখন পানি থাকে না, মাছও নাই।’ ৩৫ বছর ধরে রংপুরে আছেন অধ্যাপক তোফায়েল হোসেন। তিনিও বলছিলেন, ‘রংপুর কী সুন্দর শহর ছিল। এখন আর সেই সৌন্দর্য নেই। পরিষ্কার শহরটা এখন নোংরা হয়ে আছে।’ আমার বন্ধু মাহফুজুল ইসলাম। অনেক দিন পর রংপুরে এসে বলছে, ‘রংপুর কেমন সিটি করপোরেশন? কোনো ট্রাফিক–ব্যবস্থা নেই। অটোরিকশার যানজট তো ভয়াবহ।’ রংপুর সিটি করপোরেশনের পার্ক মোড়ে দাঁড়িয়ে সিটি করপোরেশন প্রসঙ্গে একজন সাধারণ নাগরিকের মন্তব্য, ‘দেশের নাকি অনেক উন্নয়ন হইচে, হামরা তা কই বুঝি? রংপুর সিটির তো কোনো উন্নয়ন হয় নাই।’
রংপুর সিটি করপোরেশনে কয়েকটি ড্রেন এবং কিছু সড়কবাতি ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। সেই ড্রেনের কাজ কোথাও কোথাও জনদুর্ভোগ বাড়িয়েছে। যেমন নগরের পার্ক মোড় এলাকা থেকে লালবাগ পর্যন্ত এলাকার মাত্র দেড় কিলোমিটার ড্রেনের কাজ চার বছরেও শেষ হয়নি। কাজ শুরু হওয়ার আগে সড়কের পানি খুব সহজেই নেমে যেত। এখন অল্প বৃষ্টি হলে সড়ক হয়ে ওঠে নদী।
২০১০ সালে রংপুর জেলা শহর থেকে বিভাগীয় শহরে উন্নীত হয়েছে। ২০১২ সালে রংপুর পৌরসভা থেকে হয়েছে সিটি করপোরেশন। মাত্র ৫০ বর্গকিলোমিটারের পৌরসভার আয়তন বেড়ে হয়েছে ২০৫ বর্গকিলোমিটার। পরবর্তী সময় এটি মেট্রোপলিটন শহরে উন্নীত হয়েছে। শহরে জনসমাগম বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় কার্যালয় হয়েছে। কিন্তু এই শহরের কোনো মাস্টারপ্ল্যান হয়নি। সিটি করপোরেশনের কোনো অর্গানোগ্রাম নেই। নতুন সিটি করপোরেশন হিসেবে পাওয়া যায়নি পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ। ফলে এই শহরের যে বিস্তৃতি, তা চরমতম অপরিকল্পিত আর অব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে চলছে।
সিটি হয়া হামার ক্ষতি হইচে। আগে রিলিফ পাছি। অ্যালা রিলিফ নাই। টিনের বাড়ি তারও ট্যাক্স দেওয়া নাগে। চাষের ভুঁই (জমি) তারও খাজনা বাচ্ছে (বাড়ছে)। খালি অসুবিধা। সিটি না হওয়ায় ভালো আচলো। রংপুর সিটির কি উন্নতি হইবে?’ রংপুর শহরে অনেক বস্তি আছে। সিটি করপোরেশন হওয়ার কারণে বস্তিবাসী গৃহহীন হওয়া সত্ত্বেও সরকারের দেওয়া বাড়ি তাঁরা পাননি। সিটি করপোরেশন আইনে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। গৃহহীন মানুষ গৃহের জন্য আন্দোলন করছেন।
রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়গুলো গড়ে উঠছে রংপুর শহর থেকে অনেক দূরে। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরের দিকে। এর কারণ সৈয়দপুরে একটি বিমানবন্দর আছে। তফসিলি অনেক জমি অধিগ্রহণ করে নতুন নতুন স্থাপনা হচ্ছে। যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা ঢাকা থেকে রংপুরে আসেন বিমানযোগে। ফলে বিমানবন্দরের দিকেই শহর গড়ে উঠছে। অথচ সড়ক কিংবা রেলপথে ঢাকার যোগাযোগ আমলে নেওয়া হয়নি। গুটিকয় মানুষের জন্য শহরের বৃদ্ধি হচ্ছে উল্টো দিকে। বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো সন্তানের মতো রংপুর সিটি করপোরেশনের অবস্থা।
রংপুর সিটি করপোরেশনের ভেতরের সব সড়ক এখনো পাকা হয়নি। অনেক সড়কে এখনো সড়কবাতি দেওয়া হয়নি। বিভাগীয় শহর হওয়ার পরপরই প্রধান সড়ক সামান্য প্রশস্তকরণের কাজ হয়েছে। সেই সড়কের কাজ শেষ হতেও অনেক বছর লেগেছে। সড়কের দুই পাশের বড় গাছগুলো কাটা হয়েছিল, আর রোপণ করা হয়নি। দেশের আর কোনো সিটি করপোরেশন পাওয়া যাবে না, যা এতটা বেহাল।
শহরের ফুটপাতগুলো অবৈধ দখলে। গাড়ি পার্কিং হয়, ছোট ছোট দোকান বসে সড়কে। শহরের সড়ক প্রশস্ত হলেও যানজট বেড়েই চলছে। প্রয়োজনের তুলনায় অস্বাভাবিক হারে বেশি আছে অটোরিকশা। এগুলোর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। রংপুরের ড্রেনেজ–ব্যবস্থা দুর্বল। শহরের অনেক স্থানে প্রধান সড়কেই তৈরি করা হয়েছে ডাস্টবিন। এখানে বিনোদনকেন্দ্রের অভাব, খেলার পর্যাপ্ত মাঠ নেই, পড়ার গ্রন্থাগার নেই। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রেরও অভাব। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গড়ে উঠলে এই শহরের উন্নয়ন পরিকল্পিত হতো এবং উন্নয়ন বাড়ত। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলার কোনো প্রচেষ্টাই নেই।
রংপুর সিটি করপোরেশনের দুজন মেয়র তাঁদের মেয়াদ পূরণ করেছেন। চলতি ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ রংপুর সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা আবদুল হাকিম বলছিলেন,Ñ ‘সিটি হয়া হামার ক্ষতি হইচে। আগে রিলিফ পাছি। অ্যালা রিলিফ নাই। টিনের বাড়ি তারও ট্যাক্স দেওয়া নাগে। চাষের ভুঁই (জমি) তারও খাজনা বাচ্ছে (বাড়ছে)। খালি অসুবিধা। সিটি না হওয়ায় ভালো আচলো। রংপুর সিটির কি উন্নতি হইবে?’ রংপুর শহরে অনেক বস্তি আছে। সিটি করপোরেশন হওয়ার কারণে বস্তিবাসী গৃহহীন হওয়া সত্ত্বেও সরকারের দেওয়া বাড়ি তাঁরা পাননি। সিটি করপোরেশন আইনে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। গৃহহীন মানুষ গৃহের জন্য আন্দোলন করছেন।
প্রায় ১০ বছর হলো এই সিটি করপোরেশনের বয়স। কিন্তু এর কোনো উন্নয়ন নেই। এবারে যিনি মেয়র নির্বাচিত হবেন, তিনি কি পারবেন সিটি করপোরেশনের নাগরিকদের সুবিধা নিশ্চিত করতে? নাকি নাগরিকদের সেবার মান ক্রমে অবনতির দিকেই যাবে?
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক