গোটা বিশ্বে বাংলাদেশই মনে হয় একমাত্র দেশ, যার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিত আলোচনায় থাকেই মূলত ছাত্ররাজনীতির কারণে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বহুবিধ সমালোচিত কর্মকাণ্ডের কারণে। প্রায়ই দিন দেশের কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে ‘আওয়াজ’ দিয়ে ওঠেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা, যার শিকার হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। হয় তাঁদের হামলায় কোনো শিক্ষার্থী আহত হচ্ছেন বা কেউ হল-ক্যাম্পাসছাড়া হচ্ছেন বা কেউ যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এমনকি শিক্ষকদেরও আক্রান্ত করতে ছাড়ছেন না তাঁরা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি কলেজগুলোর এমন চিত্র অনেকটা ‘গা সওয়া’ হয়ে গেছেই বলা যায়। অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানকে ‘আল্লাহর ওয়াস্তে ছেড়ে দিলাম’ বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান বললে ভুল হবে না।
এ পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও ‘এমন সব কর্মকাণ্ডের’ আওতায় আনার ‘ইচ্ছাপোষণ’ করল ছাত্রলীগ! সম্প্রতি ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করেছে সংগঠনটি, যার মধ্যে চারটি ছাড়া ১২টিই রাজধানীতে। এ নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন, উপাচার্য, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ও আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছি আমরা। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনও তা-ই বলছে।
তাহলে কি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকবে না? অবশ্যই থাকবে, এ দেশের ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকাই সেটি দাবি রাখে। কিন্তু ক্ষমতাচর্চা, দুর্বৃত্তায়ন ও পেশিশক্তির রাজনীতির হালহকিকতে সেই ছাত্ররাজনীতির অস্তিত্ব আদৌ কি আছে, তা নিয়েও আমাদের সন্দিহান হতে হয়।
দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৮। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও এ সংখ্যা দ্বিগুণ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ পসারের অনেকগুলো কারণের একটি হচ্ছে, ছাত্ররাজনীতির অনুমোদন না থাকা। ফলে অভিভাবকেরা কষ্টার্জিত অর্থে তাঁদের সন্তানদের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে নিরাপদ বোধ করেন। কলুষিত ছাত্ররাজনীতির পাল্লায় পড়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট হোক, সেটি তাঁরা চান না। এসব অভিভাবকদের নিশ্চিতভাবেই অনেকে হতে পারেন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি, অনেকে একসময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমনকি অনেকে রাজনৈতিক নেতাও।
তাহলে কি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকবে না? অবশ্যই থাকবে, এ দেশের ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকাই সেটি দাবি রাখে। কিন্তু ক্ষমতাচর্চা, দুর্বৃত্তায়ন ও পেশিশক্তির রাজনীতির হালহকিকতে সেই ছাত্ররাজনীতির অস্তিত্ব আদৌ কি আছে, তা নিয়েও আমাদের সন্দিহান হতে হয়।
তবে এখানে ইস্যুটা সেই অর্থে ছাত্ররাজনীতিও বলা যাবে না। কারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চালু থেকেও প্রসঙ্গটার মনোযোগ মূলত সেখানে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো থেকে এমন কোনো কিছুর ইঙ্গিত বা তৎপরতা আমরা পাই না, তবে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর ছাত্রদলও এ ব্যাপারে সরব হচ্ছে বলে আমরা জানতে পারছি। যদিও দুই ছাত্রসংগঠনেরই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি ইউনিট বা শাখা আছে।
ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির অনুমোদন দেওয়া হবে না বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে। এগুলো হলো ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, এআইইউবি ও আইইউবিএটি। ছাত্রলীগ বলছে, শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে কাজ করার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি করা হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ছাত্ররাজনীতি করার সুযোগ দিতে হবে।
কিন্তু ক্যাম্পাসে যখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের একক ক্ষমতা ও জোরজবরদস্তি কায়েম হয়, সেখানে একজন শিক্ষার্থীর স্বাধীনভাবে ছাত্ররাজনীতি করার সুযোগ আসলেই কি থাকে? ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির উপস্থিতি নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ আমরা দেখতে পাচ্ছি। যার একটি কারণ হতে পারে, কারও ইচ্ছা থাকলেও সেখানে ছাত্ররাজনীতি করার সুযোগ নেই, তাঁকে ছাত্রলীগই করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতির নানা উদাহরণ তো তাদের সামনেই আছে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্ররাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছে। তাদের উদ্দেশে বলব, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দয়া করে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেবেন না।’
সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে জঙ্গিবাদ অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই বলা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারির বাইরে দলীয় ছাত্রসংগঠন দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তাও নেই এখন। হোলি আর্টিজানের ঘটনায় হামলাকারীদের মধ্যে যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র যুক্ত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়, তখন কিন্তু ছাত্রলীগের এমন তৎপরতা আমরা দেখিনি।
তবে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘ঢোকার’ চেষ্টা করে ছাত্রলীগ, যদিও পরে সেই প্রচেষ্টা স্তিমিত হয়ে পড়ে। তাহলে এখন কী এমন কারণে ছাত্রলীগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করল?
প্রথম কারণ হতে পারে, সামনে নির্বাচন। দেশে এমন কোনো সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে ছাত্রলীগের আধিপত্য নেই, একমাত্র বেসরকারিগুলো ছাড়া। অতএব নির্বাচন সামনে রেখে সেসব প্রতিষ্ঠানেও নিজেদের অবস্থান জরুরি মনে করছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনটি। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের গ্রিন সিগন্যাল থাকাটা অস্বাভাবিক না। যার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি অনুমোদন না থাকার বিষয়টি জানা থাকা সত্ত্বেও ছাত্রলীগের এমন কার্যক্রমের প্রতি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির নমনীয় বক্তব্য আমরা দেখতে পাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রলীগ ‘ছায়া প্রশাসন’ তৈরি করেছে। ভাবনাটা হয়তো এমন যে, এ থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মুক্ত থাকবে কেন!
দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, সরকারের সমালোচনা করার পথ আরও বেশি রুদ্ধ করে তোলা। তার মানে মতপ্রকাশের পথ আরও বেশি সংকুচিত করা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক মতপ্রকাশ করার সুযোগ নেই বললেই চলে। সরকারের সমালোচনা দূরে থাক, ভিন্নমত প্রকাশ করায় নিপীড়নের শিকার হয়ে গত এক যুগে অনেক শিক্ষার্থীকে হল ও ক্যাম্পাসছাড়া হতে হয়েছে, নির্যাতনের ফলে মানসিক বিপর্যয় থেকে মুক্তি পেতে দেশত্যাগ করার ঘটনাও আছে। আবরার ফাহাদের উদাহরণ টেনেই বলা যায়, হত্যার শিকার হওয়াটাও এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনীতি নিয়ে সরাসরি মতপ্রকাশ করার সুযোগ তো নেই, এমনকি সরকারের বিপক্ষে যায়, এমন কোনো সংবাদের লিংক শেয়ারও বাধা পেতে হয়। কিন্তু সরকার, সরকারি দল, ছাত্রলীগের কার্যক্রম বা নীতির সমালোচনা করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দমিয়ে রাখার সুযোগ কম। কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ এখন সেটিই করতে চাইছে।
তৃতীয় কারণ হতে পারে, কমিটির পদপদবি-বাণিজ্য। ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি দেওয়ার পর বাকিগুলোতেও সেটি করবে ছাত্রলীগ। এর ফলে কমিটিতে পদপ্রাপ্তির মাধ্যমে ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ জেলা-উপজেলার বিভিন্ন ইউনিটে ছাত্রসংগঠনগুলোর পদ-বাণিজ্য নতুন কিছু নয়। ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে পদ-বাণিজ্য করার অভিযোগ সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। এর আগের কেন্দ্রীয় কমিটির পদত্যাগ করা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মোটাদাগে এমন অভিযোগ পাওয়া যায়।
একেকটি ইউনিটে কয়েক শ জনের বিশাল কমিটি ঘোষণা করার অন্যতম কারণও পদ-বাণিজ্য; যার কারণে সেখানে অছাত্র, বয়স্ক, বিবাহিত ও অযোগ্যদেরও সহযোগে ঠাঁই মেলে। এখন এতগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি ঘোষণার মাধ্যমে সেই বাণিজ্যের আরও বেশি পসার হবে, সেটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে চাঁদাবাজি ও নিয়োগ-বাণিজ্যের বিষয় তো আছেই।
এ দেশের তরুণদের নানাভাবে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া চলমান। সেখানে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে, সেটি নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হতে হয়। দিন শেষে এটি একটি দেশের গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার জন্য প্রতিবন্ধকতাই।
কোনো দেশের গণতান্ত্রিক চরিত্র নির্ভর করে তার নাগরিকের রাজনৈতিক সচেতনতার মধ্য দিয়ে। সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতির হাতেখড়ি ঘটে তাঁদের। পরে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার শক্তিও আসে সেখান থেকে। কিন্তু সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করার আদর্শভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি যখন কলুষিত হয়ে পড়ে এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও নেতাসর্বস্ব হয়ে পড়ে, সেখানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক না হলেও দুঃখজনকই বটে, সেইসঙ্গে দুর্ভাগ্যজনকও। এখানে আমাদের শঙ্কিত হতেই হয়।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক। ই–মেইল: [email protected]