ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ চলছে। আরও বড় পরিসরে এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হবে কি না, সেই সমীকরণ মেলাতে এখন ব্যস্ত সবাই।
আপাত এই সংক্ষিপ্ত হামলা ও পাল্টা হামলায় কার কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হলো, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা।
আসলে এই যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নেবে, তা বলা মুশকিল। কারণ, এই যুদ্ধ এখন আর ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে এখন প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বমোড়লেরা জড়িয়ে পড়েছেন।
ইরান-ইসরায়েলের সামরিক হামলা ও কথার যুদ্ধের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, তুরস্কসহ আশপাশের সব দেশই এই যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছে। কেউ হুমকি দিয়েছে।
কেউ শান্তি বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছে। আপাতত ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ মনে হলেও অনেক দেশই এই যুদ্ধে ইতিমধ্যেই নানাভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
এই যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে যদি বিশ্লেষণ করি, তবে প্রথমেই আমাদের মনে রাখতে হবে, ইরানের ইসরায়েলে হামলা না করে উপায় ছিল না।
দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েল ইরানকে নানাভাবে উসকানি দিচ্ছিল। ইরানের অভ্যন্তরে একাধিকবার গুপ্ত হামলা করেছে তারা।
ইসরায়েল ইরানের বেশ কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে বলে ইরান অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানের বেশ কিছু কৌশলগত স্থাপনায় হামলা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রও হামলা করেছে এসব স্থানে। যে কারণে ইরান পাল্টা হামলা করেছে। এমন না যে ইরান আগ বাড়িয়ে হামলা করেছিল।
কিন্তু এবার পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। ইসরায়েলের সব থেকে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, অনেক চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি এই যুদ্ধে যুক্ত করতে পারেনি।
ইসরায়েলকে রক্ষার অঙ্গীকার করলে যুদ্ধে যুক্ত হতে বা ইরানে হামলা করতে যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
সম্ভবত এ কারণেই এই যুদ্ধ আর না-ও বাড়তে পারে। মানে বড় ধরনের যুদ্ধ সম্ভবত হতে যাচ্ছে না। আজ থেকে ২০ বছর আগে হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল মিলে ইরানকে কবজা করে ফেলত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ হামলার মুখে ইরান টিকতে পারত না।
দুটি জিনিস যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে পারে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ায় দীর্ঘ যুদ্ধের ধকল টানতে টানতে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্র এখন ক্লান্ত। ইউক্রেনের যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।
ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে গেছে রাশিয়ার কাছে। রাশিয়ার অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, অনেক রুশ জেনারেল নিহত হয়েছেন, পশ্চিমা গণমাধ্যমে এই সংবাদ পরিবেশিত হলেও হারানো জমি ইউক্রেন আর উদ্ধার করতে পারেনি।
এতেই প্রমাণিত হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে নেই।
আর বিশেষ করে ইউরোপের পক্ষে নতুন করে আর কোনো বড় সংঘাতের বোঝা টানা সম্ভব নয়। যেখানেই যুদ্ধ শুরু হোক না কেন, শরণার্থীরা সব ইউরোপে এসে উপস্থিত হন।
সিরিয়া ও ইউক্রেনের মিলিয়ে এক জার্মানিতেই ৩০ লাখের মতো শরণার্থী অবস্থান করছেন। এই অবস্থায় ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হলে দুই দেশ থেকেই দলে দলে শরণার্থী ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করবেন।
শুধু এই দুই দেশই নয়; এদের প্রতিবেশী দেশের শরণার্থীরাও এই যাত্রায় যুক্ত হবেন। তাই যুদ্ধ শুরু করার আগে অনেক হিসাব-নিকাশ মাথায় রাখতে হবে।
যদি কোনো কারণে পুরোমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তবে সবাইকেই ভুগতে হবে। এ অবস্থায় যুদ্ধের পক্ষে ইউরোপের সায় আগের মতো না-ও থাকতে পারে।
বিপরীতে ইরান রাশিয়া ও চীনের সমর্থন পাচ্ছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে কথা বলেছেন। চীন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরামর্শ দিয়ে বলেছে ইরান একাই পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম।
এর পাশাপাশি আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক ও তুরস্কের সমর্থন মিলে যাবে ইরানের জন্য।
কেউ কেউ বলছেন, ইরানের হামলায় বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সুবিধা হবে। এমনিতেই তিনি স্বস্তিতে নেই। প্রতিনিয়তই ইসরায়েলে বিক্ষোভ হয়। অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নয়। নতুন করে যুদ্ধ নেতানিয়াহুর রাজনীতিকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। আবার এর বিপরীত মতও আছে। হামাস বা ইরানের হামলা ইসরায়েলের সামরিক খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইরানের শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলকে ৮০ কোটি পাউন্ড খরচ করতে হয়েছে এক রাতেই। এটি ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের তথ্য।
এই অবস্থায় মৌন সম্মতির ইউরোপ, দূরের দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি, জর্ডান, মিসরের সমর্থন ইসরায়েলের জন্য সুবিধাজনক না-ও হতে পারে। তাই ‘যথাসময়ে’ প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। এই ‘যথাসময়’ আগামীকালও হতে পারে। আগামী বছরও হতে পারে।
যদি সব পক্ষকে যুদ্ধের জন্য রাজি করাতে পারে এবং ইরানের পেছন থেকে রাশিয়া ও চীনের ছায়া সরে যায়, তবে আগামীকালই ইসরায়েল হামলা করবে। তেমনটা না হলে অপেক্ষা করতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন, ইরানের হামলায় বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সুবিধা হবে। এমনিতেই তিনি স্বস্তিতে নেই। প্রতিনিয়তই ইসরায়েলে বিক্ষোভ হয়। অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নয়। নতুন করে যুদ্ধ নেতানিয়াহুর রাজনীতিকে বাঁচিয়ে দিতে পারে।
আবার এর বিপরীত মতও আছে। হামাস বা ইরানের হামলা ইসরায়েলের সামরিক খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইরানের শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলকে ৮০ কোটি পাউন্ড খরচ করতে হয়েছে এক রাতেই। এটি ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের তথ্য।
স্বভাবতই অতিরিক্ত সামরিক খরচের প্রভাব সার্বিকভাবে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ইরান ও হামাস সম্ভবত এটাই চাচ্ছে। ইসরায়েলে হামলা করে তাদের খরচ বৃদ্ধি করা। গাজা থেকে শত শত রকেট নিক্ষেপ করে হামাস।
এসব রকেট খুব বেশি কার্যকর না। কোনো কোনো রকেট তৈরি করতে ৫০০ ডলারের মতো খরচ হয়। আর ৫০০ ডলারের রকেট আটকাতে ইসরায়েলের বিলিয়ন ডলারের আয়রন ডোম সক্রিয় করতে হয়।
সামরিক যুদ্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে পেরে উঠবে না হামাস। ইরান পারবে কি না, তা-ও নিশ্চিত নয়। কিন্তু ইসরায়েল যে দুর্ভেদ্য বা অজেয় নয়, এটা যদি প্রমাণ করা যায়, তবে ইসরায়েলে নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার ভয় বাড়বে।
একই সঙ্গে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাকে যুক্ত করা গেলে ইসরায়েলের অবস্থা আরও নাজুক হবে।
দ্রুত না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এর সুফল পাওয়া যাবে। কারণ, ইসরায়েলের নাগরিকদের বেশির ভাগই অভিবাসী। তাঁরা বিভিন্ন দেশ থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছেন। তাঁদের মধ্যে ইসরায়েল ত্যাগের হারও বাড়ছে।
নিরাপত্তাহীনতা তাঁদের দেশত্যাগের হার আরও বৃদ্ধি করবে। দেশত্যাগ ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ নেতানিয়াহুর রাজনীতির জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্নভাবে ইরানকে কোণঠাসা করে ফেলছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। সর্বশেষ সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে হামলার পর ইরানের হাতে আর কোনো বিকল্প ছিল না।
ইরান যদি পাল্টা হামলা না করত বা চুপচাপ হজম করে বসে থাকত, তবে পরবর্তী সময় ইসরায়েলের হামলা আরও বাড়ত ইরানের প্রতি।
একই সঙ্গে ইরানি শাসকেরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যও ইসরায়েলে হামলা করে থাকতে পারেন। এই হামলা শুধু নেতানিয়াহুকে রক্ষা করবে না; ইরানের শাসকদেরও একধরনের সুবিধা দেবে।
সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, এই যুদ্ধ ইরান হারুক বা জিতুক, যা-ই হোক না কেন, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব কার্যত ইরানের হাতে এখন। কারণ, ইরান ছাড়া আর কোনো মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এতটা সরাসরি কথা বলছে না। হামলা তো অনেক দূরের চিন্তা।
মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক