সর্বজনীন ন্যূনতম আয় নিয়ে কিছু প্রস্তাব

বৈশ্বিকভাবে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু বিশ্বের কোনো দেশই এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে স্থায়ীভাবে এ–জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করেনি। অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচিকে সীমিত আকারে এবং পরীক্ষামূলকভাবে গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ের প্রস্তাব নিয়ে লিখেছেন সেলিম জাহান

তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচিত হয়। এক. কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি ধারণা হিসেবে; দুই. প্রবৃদ্ধি বলয়ের বাইরে যাদের অবস্থান এবং যারা নিজেরা নিজেদের সুরক্ষা করতে পারে না, তাদের সহায়তা হিসেবে এবং তিন. সেই সঙ্গে একটি সমাজের দারিদ্র্য ও অসমতা দূর করার একটি পন্থা হিসেবে।

সামাজিক সুরক্ষাকাঠামোর নানা কর্মসূচি ও উপকরণ রয়েছে, যেমন প্রতিবন্ধী সহায়তা থেকে বেকারত্ব ভাতা, শিশুকল্যাণ ভাতা থেকে শর্তযুক্ত অর্থ হস্তান্তর। বিগত দশকগুলোয় বিভিন্ন দেশে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় নিয়ে বিশেষ একটি পরীক্ষামূলক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

সর্বজনীন ন্যূনতম আয় বিষয়টির কয়েকটি দিকের ব্যাপারে ধারণার স্বচ্ছতা প্রয়োজন।

প্রথমত, সর্বজনীন ন্যূনতম ধারণাটির ‘সর্বজনীনতা’ বিষয়টি বিভ্রান্তিমূলক হতে পারে। এখানে ‘সর্বজনীনতা’ মানে সামগ্রিকভাবে একটি দেশ বা সমাজের সবাই নয়, বরং সর্বজনীন ন্যূনতম আয় ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বজনীনতার অর্থ হচ্ছে সমাজে যারা এ আয়প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে, তারা প্রত্যেকেই অন্য সব বিবেচনা নির্বিশেষে (যেমন তারা প্রতিবন্ধী সহায়তা পায় কি না, অথবা তারা বৃদ্ধ ভাতা লাভ করে কি না) এ আয় প্রাপ্ত হবে।

দ্বিতীয়ত, যদিও বেশ দীর্ঘ সময় ধরে বৈশ্বিকভাবে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু বিশ্বের কোনো দেশই এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে স্থায়ীভাবে এ–জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করেনি। একাধিক দেশ এ কর্মসূচির ওপর কাজ করেছে, কিন্তু তার সব কটিই স্থানীয় পর্যায়ে পরীক্ষামূলক প্রকল্পমাত্র।

যেমন ১৯৭৪ সালে ক্যানাডা তার ম্যানিটোবা প্রদেশের মিনকোমে একটি ন্যূনতম আয় কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। তেমনিভাবে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে নামিবিয়া দেশটির ওটজিভেরো-ওমিটারা অঞ্চলের প্রত্যেক বাসিন্দাকে প্রতি মাসে ১০০ নামিবিয়ান ডলার দিয়েছিল। ফিনল্যান্ড ২০১৭-১৮ সালে ২ হাজার বেকার মানুষকে প্রতি মাসে ৫৬০ ইউরো প্রদান করেছিল।

তৃতীয়ত, সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচির ওপরে এখনো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। যেমন যুক্তরাজ্য পরিকল্পনা করছে যে একটি ন্যূনতম আয়ের পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা দেশটি অনতিবিলম্বেই গ্রহণ করবে। এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে ২ বছরের জন্য ৩০ জন বেকার মানুষের প্রত্যেককেই প্রতি মাসে ১ হাজার ৬০০ পাউন্ড করে দেওয়া হবে।

পরীক্ষামূলক সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচির তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।

এক. এই কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য দরিদ্র মানুষের বঞ্চনা এবং বহির্ভুক্তি হ্রাস করা। সে প্রত্যাশা অর্জিত হচ্ছে কি না, তার মূল্যায়ন হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে দেখা দরকার, সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের গৃহীত প্রক্রিয়া দক্ষ এবং কার্যকর কি না।

দুই. ন্যূনতম আয় হস্তান্তরের ফলে যারা এর সুবিধাভোগী, তাদের কাজ করার ইচ্ছার ওপরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, সেটা পরীক্ষা করা দরকার।

তিন, পরীক্ষামূলক আয় হস্তান্তর কর্মসূচির মাধ্যমে নির্ণয় করা যে একটি সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচির ব্যয় কী পর্যায়ের হতে পারে। এসব বিষয়ের উত্তরের ওপরেই পরীক্ষামূলক সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচির বিস্তার এবং অন্যান্য দেশে এর বাস্তবায়নের বিষয়টি নির্ভর করছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচি গ্রহণ সম্পর্কে যে আলোচনা চলছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আজকের বাংলাদেশে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনকল্পে জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় ধারণাটি অত্যন্ত সংগতিপূর্ণ।

এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যাবে; যারা বাজারব্যবস্থার বাইরে আছে ও নিজেদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে না, তাদের রক্ষা করা যাবে; এবং বাংলাদেশকে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে রূপান্তর করার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

দেশে দারিদ্র্য হ্রাস করা, নাগরিকদের ক্ষমতায়ন, সামাজিক সুরক্ষাকাঠামোকে জোরদার করার জন্য দেশের বর্তমান অর্থায়ন কাঠামোর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাপূর্ণ একটি সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কার্যক্রমের প্রস্তাব সম্প্রতি করা হয়েছে।

মোটাদাগে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে:

এক. এই কার্যক্রমের অধীন নির্দিষ্ট সময়-ক্রমানুসারে, নিঃশর্তভাবে, অভিন্ন একটি অর্থানুদান–ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। এতে সমাজের সব জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আর্থিক সুরক্ষাকাঠামো গড়ে উঠবে।

দুই. বর্তমান সময়ে একাধিক বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য একটি আংশিক ন্যূনতম আয়কাঠামোকেই যৌক্তিক বলে ধারণা করা হয়েছে।

তিন. ন্যূনতম আয়প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যোগ্য জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে একটি ‘দারিদ্র্য নম্বরপত্রীর’ সুপারিশ করা হয়েছে।

এমন একটি নম্বরপত্রী এ চিহ্নিতকরণের জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং ব্যয়-কার্যকর উপকরণ বলে মনে করা হয়। সমাজের কোন কোন পরিবার দারিদ্র্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটি নাজুক অবস্থানে আছে, তা নির্ণয় করার জন্য প্রস্তাবিত দারিদ্র্য নম্বরপত্রীর সীমারেখাটি অত্যন্ত উপযোগী।

এর মানে হচ্ছে, যেসব গৃহস্থালির নম্বর ওই সীমারেখার নিচে, তারা অনেক বেশি দারিদ্র্য-নাজুক। এ রকম একটি মূল্যায়নকাঠামো প্রস্তাবিত সর্বজনীন ন্যূনতম আয় ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়নকে নিশ্চিত করবে।

প্রস্তাবিত ব্যবস্থাটিকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমত, বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিরসনের জন্য দেশের বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষাকাঠামোর চেয়ে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় আরও বেশি কার্যকর বলে উত্থাপিত প্রস্তাবে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে।

তার মানে কি এই যে অন্য সব সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থাগুলো কি বাদ দিয়ে দেওয়া হবে? নাকি বাংলাদেশের বর্তমান সব সুরক্ষা উদ্যোগগুলোকে একত্র করে একটি সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষাকাঠামো গড়ে তোলা হবে? তেমনিভাবে, সুরক্ষাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যদি দ্বিত্বতা দেখা যায় (যেমন যদি কেউ সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ের ওপরও অন্য কোনো সুরক্ষা সুবিধা পান), তাহলে কি তার অন্য সুবিধাগুলো কাটা যাবে?

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ব্যবস্থাকে শর্তহীন অর্থ হস্তান্তর বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেহেতু শর্তহীন অর্থ হস্তান্তর বনাম শর্তসাপেক্ষ অর্থ হস্তান্তর বিষয়ে বিশ্বব্যাপী একটি দীর্ঘকালীন বিতর্ক রয়েছে, তাই বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় পন্থাটি কি আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচিত হওয়া উচিত নয়?

এটা প্রয়োজন; কারণ, ব্রাজিলের বোলসা ফ্যামিলার মতো একটি শর্তসাপেক্ষ অর্থ হস্তান্তর কর্মসূচি আছে, যা শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত সর্বজনীন আয় কর্মসূচির বাস্তবায়ন পরিকল্পনাটি সুচিন্তিতভাবে মূল্যায়িত হওয়া দরকার। এ জাতীয় কর্মসূচির আমলাতান্ত্রিক কাঠামোটি অত্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর হতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত সর্বজনীন ন্যূনতম আয়কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে আরও দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, প্রয়োজনীয় জনগোষ্ঠীর শনাক্তকরণ। প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের গ্রামীণ ও নগরাঞ্চলের নিজস্ব বিশেষত্ব বিবেচনা করে আলাদা করে দারিদ্র্য নম্বরপত্রী নির্ধারণ করা হবে। দুটো অঞ্চলের জন্য নিজ নিজ অঞ্চলের ঊর্ধ্ব দারিদ্র্যরেখার ভিত্তিতে ন্যূনতম আয়ের সীমারেখা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

গ্রামীণ অঞ্চলে সেই নম্বরপত্রীর মান যদি ৫২–এর কম হয়, আর শহরাঞ্চলে যদি সে মান ৪৮–এর কম হয়, তাহলে ন্যূনতম আয়প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জন করা যাবে। এ প্রসঙ্গে অবশ্য দুটো প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক।

এক. করে এ মান দুটো নির্ণয় করা হয়েছে? সে ক্ষেত্রে কি বেশি কাজ করেছে—বস্তুনিষ্ঠতা নাকি মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি? দুই. ভবিষ্যতে যদি নানা কারণে উপরিউক্ত ঊর্ধ্ব দারিদ্র্যরেখা বদলে যায়, তাহলে কী কী নম্বরপত্রী বদলে যাবে?

দ্বিতীয়ত: সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচি বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় হবে না। বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত কর্মসূচিতে বলা হয়েছে যে যোগ্য জনগোষ্ঠীর প্রত্যেককে প্রতি মাসে ৪৫৪৯ টাকা দেওয়া হোক। সেটা করা হলে সরকারি কোষাগারের অর্থ ব্যয় হবে ৭৫ হাজার কোটি টাকা।

যে দেশে কর-জাতীয় আয়ের অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ, সেখানে এ বিরাট অঙ্কের অর্থের জোগান দেওয়া বাংলাদেশের ওপরে একটা বিরাট চাপ সৃষ্টি করবে। সেই সঙ্গে অন্য একটি প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক—ন্যূনতম আয় কর্মসূচির জন্য এ অর্থের জোগান দিতে গিয়ে কি অন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো সংকুচিত হয়ে যাবে না?

শেষত, এটা অত্যন্ত স্বস্তির কথা যে অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচিকে সীমিত আকারে এবং পরীক্ষামূলকভাবে গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় বাংলাদেশের দরিদ্রতম ১১টি জেলায় এটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে।

এটা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বিচক্ষণ একটি পদক্ষেপ। যদি নিরীক্ষণ এবং মূল্যায়ন এর সম্ভাবনার পক্ষে রায় দেয়, তাহলে বাংলাদেশে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচিকে জাতীয়ভাবে বিস্তৃত ও বজায়ক্ষম করা যাবে।

  • সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক