দৈনিক বণিক বার্তার গত ২৩ নভেম্বর সংখ্যার পেছনের পাতার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা দিয়ে সোজা হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ’। খবরটিতে উল্লিখিত রেলপথটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চলমান বলে জানানো হয়েছে।
খবরটি পড়ে আমার মনের দুঃখ উতলে উঠল। কারণ, এ পর্যন্ত কতবার যে ঢাকা-লাকসাম কিংবা ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পটির কথা উঠেছে আবার ভুলেও যাওয়া হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, আশির দশকে এরশাদের আমলে ট্রেনে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব বর্তমান ২১৩ মাইল (৩২৪ কিলোমিটার) থেকে ৬৩ মাইল কমিয়ে ১৫০ মাইলে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল।
১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর প্রকল্পটি ‘কোল্ড স্টোরেজে’ চলে গিয়েছিল। অথচ ওই অপ্রয়োজনীয় ৬৩ মাইল ঘুরে আখাউড়া-ভৈরব হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার কারণে প্রতিটি ট্রেনের যে দেড় ঘণ্টা সময় বেশি লাগছে, তার ফলে ট্রেনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি এবং প্রত্যেক যাত্রীর সময়ের অপচয় ও আয়ুক্ষয়ের ব্যাপারটি গত ৩৫ বছরে কত হাজার কোটি টাকা গচ্চার ইতিহাস রচনা করেছে, সেটা আমাদের শাসকদের বিবেচনায় এখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল না!
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রেলওয়ে বিভাগ সরকারের আলাদা মন্ত্রণালয় হওয়ার পর সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের ২০১৫ সালের একটি ঘোষণায় আমরা জানলাম যে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইনের পরিবর্তে দাউদকান্দি হয়ে ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন স্থাপনের মাধ্যমে ওই ৬৩ মাইল দূরত্ব কমিয়ে আনা হবে।
মুজিবুল হক সুনির্দিষ্টভাবে তারিখ ঘোষণা করেছিলেন যে পরবর্তী বছরের মধ্যেই ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে সত্যিকার অর্থে এ দেশের রেল যোগাযোগব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হতো। দুঃখজনক হলো, ওই ঘোষণার পর আরও প্রায় পৌনে চার বছর মুজিবুল হক রেলমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পের আর কোনো অগ্রগতির খবর জানা যায়নি।
বাস্তবতা হলো, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ৭৬ বছর এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর পার হওয়ার প্রান্তে উপস্থিত হওয়া সত্ত্বেও এখনো আমাদের কোনো সরকার এই ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব মাত্র ১৫০ মাইলে নামিয়ে আনার মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি শুরু করতে পারেনি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দৈর্ঘ্য মাত্র ১৫০ মাইল, অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দৈর্ঘ্য ২১৩ মাইল। আমরা অনেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের আখাউড়া হয়ে ২১৩ মাইলের অস্বাভাবিক ঘুরপথের আসল ঐতিহাসিক কারণটি হয়তো উপলব্ধি করি না।
ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক ভারতে রেলপথ স্থাপন করা হয়েছিল ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক স্বার্থে। তাই আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয়েছিল চট্টগ্রামে এবং সিলেট ও আসামের শত শত চা-বাগানের উৎপাদিত চা যাতে ওই রেলওয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে পরিবাহিত হয়ে বিদেশে রপ্তানি করা যায়, সেটাই ছিল আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার অর্থনৈতিক মৌল যুক্তি।
সে জন্যই চট্টগ্রাম থেকে বর্তমান রেললাইনটি আখাউড়া হয়ে সিলেট ও আসামে চলে গেছে। আখাউড়া থেকে ঢাকা যাওয়ার রেলপথ প্রতিষ্ঠা আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল না কিংবা রাজস্ব আহরণের প্রধান সূত্রও বিবেচিত হয়নি। কারণ, প্রতিষ্ঠাকালে যাত্রী পরিবহন ওই রেলপথের রাজস্বের মূল সূত্র ছিল না।
নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ঢাকা নগরীর মেট্রোরেলের সঙ্গে ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন এবং দক্ষিণাঞ্চলের রেলপথ যুক্ত করে দেওয়া হলে দেশের রেল নেটওয়ার্ক একটা আধুনিক যুগে প্রবেশ করবে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান হওয়ার সময় তিন-চতুর্থাংশের বেশি চা-বাগান আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে। তবু পাকিস্তান আমলে চা রপ্তানি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতো। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের চা রপ্তানির একমাত্র নিলাম হতো চট্টগ্রামে, এখন শ্রীমঙ্গলে নিলামের প্রধান অংশটা স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশ থেকে চা রপ্তানিও অনেক হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যাত্রী পরিবহন ক্রমে অনেক বেশি গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে, এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রী পরিবহনের জনপ্রিয় ও ব্যয়সাশ্রয়ী মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে।
নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ঢাকা নগরীর মেট্রোরেলের সঙ্গে ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন এবং দক্ষিণাঞ্চলের রেলপথ যুক্ত করে দেওয়া হলে দেশের রেল নেটওয়ার্ক একটা আধুনিক যুগে প্রবেশ করবে।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর পৌনে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, কিন্তু ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পটি এখনো সত্যিকারভাবে শুরু করার কোনো আয়োজন চোখে পড়ল না। নতুন করে আবার আরেকটি ব্যয়বহুল সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালানোর খবরে তাই খুশি হতে পারলাম না।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নীতিপ্রণেতাদের আরেকটি অত্যাসন্ন বাস্তবতাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। বলা হচ্ছে, প্রস্তাবিত ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইনটি শুরু থেকেই ব্রডগেজ রেলপথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু একটু দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়ে এই ১৫০ মাইলের ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ইলেকট্রিক ব্রডগেজ ট্রেন চালানোর প্রকল্প গ্রহণ করা সমীচীন মনে করি। তাহলে আড়াই ঘণ্টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়া সম্ভব হবে।
রেল ও নৌ যোগাযোগব্যবস্থা যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি এগুলোকে দরিদ্রবান্ধব পরিবহনব্যবস্থাও বলা হয়। যাত্রীদের নিরাপত্তার বিচারেও সড়ক পরিবহনের চেয়েও এগুলো শ্রেয়।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতের ট্রেনগুলোয় ভ্রমণের সুযোগ যাঁদের হয়েছে, তাঁরা ঠিকই উপলব্ধি করবেন, দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্কটিকে কতখানি সহজলভ্য ও আরামদায়ক করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ভারতে গেলে আফসোসের অন্ত থাকে না আমাদের দেশের রেলওয়ের দুর্দশার কথা ভেবে।
পরিশেষে বলব, আমাদের রেলওয়েকে প্রাপ্য অগ্রাধিকার দিন। ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পকে আর ঝুলিয়ে রাখবেন না। চলমান সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় এই কর্ডলাইনকে বৈদ্যুতিক রেলপথ হিসেবে নির্মাণের ব্যবস্থা করুন। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম-কুমিল্লা রেলপথকেও বৈদ্যুতিক রেলপথে রূপান্তরিত করুন।
● ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক