রংপুর কি সবচেয়ে নোংরা শহরের নাম হবে

রংপুর সিটি মেয়রের বাসায় ঢোকার গলির মুখে আবর্জনার স্তুপে খাবার সন্ধান করছে গরু। ১৬ জানুয়ারি দুপুরে

সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় রংপুরে বিউটি পারলার থেকে একজন বউসাজ নিয়ে রিকশা থেকে নামতে যেই-না পা ফেলেছে, সেই পা পড়েছে ধোঁয়া-ওড়া গোবরে। মানে গরু মলত্যাগের পরপরই এ ঘটনা। দামি শাড়ি, স্যান্ডেল লেপটে গেছে গোবরে। এ দৃশ্য দেখে আমার নিজের নতুন জুতাসহ গোবরে পা পড়ার কথা মনে হলো।

রংপুর শহরের বেশ কিছু এলাকায় অসংখ্য গরু চরে বেড়ায়, সেসব এলাকায় অনেকের এ অভিজ্ঞতা হওয়ারই কথা। ঘটনাটি রংপুর শহরের আবাসিক এলাকা কটকিপাড়া পিটিআই রোডে।

রংপুর সিটি করপোরেশন দিনের পর দিন আরও নোংরা শহরে পরিণত হচ্ছে। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ বাড়ছে। ঢাকা থেকে রংপুর শহরে ঢোকার মুখে লালবাগে প্রধান সড়কের ওপর কয়েক বছর আগে সিটি করপোরেশন ময়লা ফেলার জন্য পাকা করে চৌকোনা ডাস্টবিন তৈরি করেছিল। দুর্গন্ধে তখন পাশ দিয়ে যাওয়া যেত না। নাকে হাত দিয়ে যেতে হতো। বর্তমানে সেই পাকা চৌকোনা ডাস্টবিন নেই। এখন ময়লা ফেলা হয় সরাসরি সড়কের ওপর। সড়কই যেন ডাস্টবিন!

পার্ক মোড় থেকে লালবাগ পর্যন্ত একটি নর্দমা তৈরি শুরু করা হয়েছে অর্ধযুগ আগে। এখনো সেই কাজ শেষ হয়নি। সেই নর্দমা করা হয়েছে সড়কের চেয়ে অনেক উঁচু। নর্দমার ওপরের অংশ ফুটপাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফুটপাত সড়ক থেকে অনেক উঁচু হওয়ায় তা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। আগামী অর্ধযুগেও এই নর্দমার কাজ শেষ হবে কি না সন্দেহ। বৃষ্টি হলে এখন আর দ্রুত পানি নেমে যেতে পারে না। লালবাগ মোড়ে কয়েক বছর ধরে প্রধান সড়কে দিনের পর দিন পানি জমে থাকে।

বর্তমান মেয়রের বাসায় যাওয়ার যে মোড়, সেই মোড়ের নাম হয়েছে মেয়রের মোড়। মেয়রের নামে একটি মোড় হলে সেখানে অন্তত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাটুকু আমরা বেশি আশা করতেই পারি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক, তাঁর বাসায় যাওয়ার গলির মুখে ভয়াবহ দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা-আবর্জনা। কয়েক দিন আগে বেলা দেড়টার দিকে দেখলাম সেই ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। গরু, কুকুর সেই ময়লা-আবর্জনা থেকে খাবার সংগ্রহ করছে আর ছড়াচ্ছে। ছোট একটা ডাস্টবিন থাকলেও ময়লা চলে আসছে প্রধান সড়কে। 

নগরবাসীকে যেমন শহর পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে, তেমনি সিটি করপোরেশনকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। উন্নয়নে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা শহরের নাম রংপুর সিটি করপোরেশন। এখন কি সবচেয়ে নোংরা শহরের নামও হবে রংপুর?

মেয়রের বাড়ির পাশে প্রধান সড়কের ওপর গরু লালনপালন করা হয়। প্রধান সড়কের ওপর এসব গরু থাকে। কোথাও কয়েকটি গরু থাকলে সেই স্থানের পরিবেশ কী রকম হয়, পাঠক কল্পনা করে নিতে পারেন। আর যাঁরা রংপুর সিটি করপোরেশনে মেয়রের বাসার সামনে প্রধান সড়ক ধরে চলাফেরা করেন, তাঁরা নিয়মিত দেখতে পান।

রংপুর শহরে অনেক গরু ছেড়ে দেওয়া থাকে। গরুগুলো জানে কোথায় কোথায় বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়। গরু সেসব স্থানে গিয়ে বর্জ্যের ভেতরে থাকা পচা ভাত-সবজিসহ যা খাওয়ার মধ্যে পড়ে, সেসব খায়। সড়কের ওপর যে গোবর থাকে, তা বিভিন্ন গাড়ির চাকায় পিষ্ট হতে হতে শেষ হয়। সেগুলোর ছিটেফোঁটা পড়ে নগরবাসীর গায়ে, কখনো কখনো মুখে। মাঝেমধ্যে দেখি শহর ঝাড় দেওয়া হচ্ছে। ঝাড় দেওয়া হয় সন্ধ্যায়, যখন মানুষের যাতায়াত বেশি থাকে।

রংপুর শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে শ্যামাসুন্দরী নামের একটি প্রবাহ। সিএস নকশায় যেটাকে ‘স্ক্রাইন খাল’ বলা হয়েছে। নদীবিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক এটাকে নদী বলে উল্লেখ করেছেন। জেমস রেনেলের ম্যাপ সূত্রে দেখা যায় এটি পুরোনো ঘাঘট। এই শ্যামাসুন্দরীতে দখল আর দূষণ অব্যাহত রয়েছে। প্রায় ১০ কিলোমিটারের একটি প্রবাহকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং দূষণমুক্ত রাখতে ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।

শ্যামাসুন্দরী হতে পারত নগরের প্রধান সৌন্দর্য। এর পাশে বৈকালিক আড্ডা বসতে পারত। রঙিন আলোয় ঝলমল করতে পারত রাতের শ্যামাসুন্দরী। সেটা তো হয়ইনি, বরং এর পাশে রিকশা যদি জটে আটকে যায়, তাহলে যাত্রীদের বমি ভাব হয়। শ্যামাসুন্দরীর দিকে তাকিয়ে থাকা অসম্ভব।

রংপুর জেলা জজ আদালত চত্বরের সামনে শ্যামাসুন্দরীতে দখল তথা ভরাটপ্রক্রিয়া বেড়েছে। কোতোয়ালি থানার পাশেও ভরাটপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। শ্যামাসুন্দরীর উৎস কাঠেরপুল এলাকায় ঘাঘটের তলদেশ থেকে শ্যামাসুন্দরীর তলদেশ এখনো প্রায় ৩০ ফুট উঁচু হয়ে আছে। টলটলে পানির স্রোত যেখানে কয়েক বছর আগেও প্রবহমান ছিল, সেটি এখন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অনেক বাসার পয়োনালা আছে শ্যামাসুন্দরীতে। অনেক স্থানে শ্যামাসুন্দরীতে ফেলা হয় ময়লা-আবর্জনা।

চরম অপরিকল্পিতভাবে রংপুর শহরের বিকাশ হচ্ছে। আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা বলে কিছু নেই। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এখনো গড়ে ওঠেনি। যার যেখানে যা ইচ্ছা করছে। এদিকে প্রতিদিন বাড়ছে রংপুরের বাস করা মানুষের সংখ্যা। বাড়ছে অফিস, ঘরবাড়ি। সেই তুলনায় একেবারেই বাড়ছে না পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগ।

আমরা চাই রংপুর শহরকে পরিকল্পিত এবং পরিচ্ছন্ন শহরে পরিণত করা হোক। এ ক্ষেত্রে নগরবাসীকে যেমন শহর পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে, তেমনি সিটি করপোরেশনকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। উন্নয়নে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা শহরের নাম রংপুর সিটি করপোরেশন। এখন কি সবচেয়ে নোংরা শহরের নামও হবে রংপুর?

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

[email protected]