বৈশ্বিক মানে তলানির দিকে থাকলেও ফুটবল উন্মাদনায় সামনের কাতারে বাংলাদেশ। মাস দু-এক ধরে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তাপের সৃষ্টি হয়েছে, ফুটবলের কাছে তা-ও অনেকটা স্তিমিত। সবকিছু ছাপিয়ে এখন ফুটবলের গণ-উন্মাদনা সর্বত্রই। রাস্তাঘাট, অলিগলি, নগর থেকে গ্রাম এখন সবখানেই মূল আলোচনার বিষয় ফুটবল। প্রিয় দলের পতাকা উড়ছে, প্রিয় দেশের জার্সি গায়ে চাপিয়ে ঘুরছে অনেকে। মোড়ে মোড়ে বড় বড় পর্দায় ভিড় করে খেলা দেখা চলছে। সমানে তর্ক, বিতর্ক আর ম্যাচের চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। কোন দলের সমর্থকেরা কত বড় পতাকা তৈরি করেছেন, সেই খবর বেশ ভাইরাল হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের সর্বোচ্চ পঠিত ও সর্বোচ্চ আলোচিত সংবাদ এখন ফুটবল। আমাদের ফুটবল উন্মাদনার খবর এখন তাই বিশ্ব সংবাদমাধ্যমেরও শিরোনাম।
বাংলাদেশের মানুষ মূলত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থক। এরপর জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা ইউরোপের আরও দু-একটি দলের সমর্থক। ফলে ফুটবলে এখানে মাতামাতিটা মূলত লাতিন আমেরিকার দুটি দলকে ঘিরেই। এই মাতামাতি, সমর্থন নির্দোষও থাকছে না অনেক সময়ই। রসিকতা ও খোঁচা অনেক ক্ষেত্রেই বিতণ্ডা ও ঘৃণায় রূপ নিচ্ছে। মাঠে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল মুখোমুখি হবে কি না, সে নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। তাতে ছুরিতে আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পতাকা টাঙাতে গিয়ে সমর্থকের মৃত্যুর খবরও এসেছে। খেলা চলাকালে উত্তেজনায় হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুও হয়েছে সমর্থকের।
বাজারকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে গোষ্ঠীর ওপর। বাংলাদেশে চালের দাম উৎপাদনকারী যেকোনো দেশ থেকে অনেক বেশি কেন? এর উত্তর পাওয়া যাচ্ছে ১৯ নভেম্বর ব্রির করা গবেষণা নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে। মিলমালিকেরা চালের কেজিতে আট টাকা লাভ করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রধান সংকট কী? নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো এখানে গুটিকয়েক গোষ্ঠীর স্বার্থেই নেওয়া হয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখানে নিজেদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত।
পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদো, মেসি, নেইমারদের খেলার সূত্র ধরে বাংলাদেশ লাতিন ফুটবলের সমর্থক। নয়া উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যে সংকট, তাতে বিশ্ব রাজনীতিতে যখন কর্তৃত্ববাদী, জনতুষ্টিবাদী, ডানপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটছে, তখন লাতিন আমেরিকা ভিন্ন এক পথে এগোচ্ছে। বাম গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির জোয়ার তৈরি হয়েছে সেখানে। এর সবশেষ ব্রাজিলের শ্রমিক নেতা লুলা দ্য সিলভা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্রাজিলীয় সংস্করণ বলসোনারোকে খুব সামান্য ব্যবধানে পরাজিত করে লুলা ক্ষমতায় এলেও এর তাৎপর্য বিশাল। গত কয়েক বছরে মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু ও হন্ডুরাসে মধ্যবাম বা বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে। গত বছর চিলিতে বামপন্থী তরুণ নেতা গ্যাব্রিয়েল বরিচ ক্ষমতায় এসেছেন। এ বছরের জুনে গোস্তাভো পেত্রো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, কলম্বিয়ার ইতিহাসে তিনিই প্রথম বামপন্থী সরকারপ্রধান।
লাতিনে বাম গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির বিস্তারের পেছনে বড় একটা কারণ সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি, লেখক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ সক্রিয়ভাবে বাম, গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক চিন্তাধারার চর্চা করেন। লাতিন বামপন্থীরা অভিজাত গোষ্ঠীতন্ত্রের কাছে অর্থনীতিকে পুরোপুরি সঁপে না দিয়ে শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, আদিবাসীদের কল্যাণে তা কতটা ব্যয় করা যায়, সেই পথই তৈরি করছেন। বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হলেও নীতিগত ক্ষেত্রে এই সংস্কারে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে স্বস্তির দেখা মিলছে। ফুটবলের পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার কিশোর-তরুণদের আলোচনায় পছন্দের আরেকটি বিষয় রাজনীতি।
এ ক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকার মতো বাংলাদেশের মানুষের একটা মিল রয়েছে। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৩ সালে করা এক জরিপে বিশ্বের ৩৩টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণ সবচেয়ে বেশি ‘রাজনীতি সক্রিয়’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬৫ ভাগ মানুষ উচ্চ মাত্রায় এবং ২৯ ভাগ মানুষ মধ্যম মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়। এর মানে, বাংলাদেশের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ কোনো না কোনো মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়।
নতুন করে ভোক্তা পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। ফলে আরেকটা মূল্যস্ফীতির সুনামি আসন্ন। অথচ বিদ্যুৎ খাতে অব্যবস্থাপনা ও লুণ্ঠনমূলক ভর্তুকি বন্ধ করা হচ্ছে না। গত দশ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিকে জনগণের ৭০ হাজার কোটি টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক সঞ্চয় আর আমানত নিয়ে যখন জনমনে সংশয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে, তখন দুটি ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, এমন প্রতিষ্ঠানকে, বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই।
এই সক্রিয়তা কতটা গঠনমূলক বা যৌক্তিক আর ক্ষমতাসীন শাসনের প্রতি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’—এই প্রবাদ কেন জানি বাংলাদেশের মানুষের গণমনস্তত্ত্বের ক্ষেত্রে শতভাগ সত্যি। ইতিহাসে বারবার দুনিয়া কাঁপানো আন্দোলনের স্রষ্টা হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের পক্ষে বড় কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি এ দেশের মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের আন্দোলনকে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করেনি। ক্ষমতায় গিয়ে শাসক দলগুলো নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থই রক্ষা করেছে। জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে রাজনীতিকেরা সমাজে তাঁদের অবস্থান হারিয়েছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলায় কার গায়ের জোর কত বেশি, সেটাই ক্ষমতায় কে আসবে বা থাকবে, তার বড় একটা নির্ধারক। এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বড় বড় সমাবেশ করছে। মাঠে কার কত শক্তি, তার প্রদর্শনই চলছে। ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিএনপির সমাবেশ ও আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি ঘিরে জনমনে সে কারণেই তৈরি হয়েছে শঙ্কা ও উদ্বেগ।
কিন্তু সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ও শঙ্কা এখন অর্থনীতি ও জনজীবন নিয়ে। সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি ৯-এর ঘরে। প্রকৃত আয় দ্রুত কমে যাচ্ছে। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ তাঁদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করেন খাবার কিনতে। চাল, আটা, ডাল, চিনি, মাছ, ডিমসহ প্রায় সব খাদ্যের দামের হু হু করে বাড়ছে। খাদ্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার এই সুনামি সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করেছে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ, ওষুধের খরচ, জামাকাপড়ের খরচ, ইন্টারনেট খরচ কাটছাঁট করেও তাঁরা সংসার খরচ কুলাতে পারছেন না। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছেন। অনেকে ধার-কর্জ করে ফেলেছেন। খাদ্য অধিদপ্তরের খোলাবাজার বিক্রির (ওএমএস) লাইনে মানুষের সারি তাই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এখন শুধু গরিব মানুষ নয়, মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশেরও সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু আগের দিন বিকাল কিংবা পরের দিন ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও শূন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে অনেককে।
দোকান কর্মচারীদের মধ্যে নতুন করে তৈরি হয়েছে কাজ হারানোর আতঙ্ক। টানা মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ খরচ কমিয়ে দিতে বাধ্য হওয়ায় অনেক ব্যবসা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে অনেক আমদানিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমদানিনির্ভর অনেক ব্যবসাও বন্ধ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। করোনার সময় সরকারি-বেসরকারি খাতে নিয়োগ কমে এসেছিল। এখন আবার অর্থনৈতিক সংকটে সরকারি নিয়োগও কমে আসছে। ফলে বিশাল একটা তরুণ বেকার জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তাঁদের কর্মসংস্থান কীভাবে হবে, তার কোনো সমাধান নেই।
কিন্তু এত কিছুর পরও সরকার সেই পুরানো পথেই হাঁটছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার কোনো উদ্যোগ নেই। নতুন করে ভোক্তা পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। ফলে আরেকটা মূল্যস্ফীতির সুনামি আসন্ন। অথচ বিদ্যুৎ খাতে অব্যবস্থাপনা ও লুণ্ঠনমূলক ভর্তুকি বন্ধ করা হচ্ছে না। গত দশ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিকে জনগণের ৭০ হাজার কোটি টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক সঞ্চয় আর আমানত নিয়ে যখন জনমনে সংশয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে, তখন দুটি ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, এমন প্রতিষ্ঠানকে, বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই। বিটিভি দরপত্র আহ্বান ছাড়া বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বত্ব এমন এক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিনছে, যাদের এ ধরনের ব্যবসার অভিজ্ঞতা নেই।
বাজারকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে গোষ্ঠীর ওপর। বাংলাদেশে চালের দাম উৎপাদনকারী যেকোনো দেশ থেকে অনেক বেশি কেন? এর উত্তর পাওয়া যাচ্ছে ১৯ নভেম্বর ব্রির করা গবেষণা নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে। মিলমালিকেরা চালের কেজিতে আট টাকা লাভ করেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রধান সংকট কী? নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো এখানে গুটিকয়েক গোষ্ঠীর স্বার্থেই নেওয়া হয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখানে নিজেদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। রাজনৈতিক সক্রিয়তার পাশাপাশি অধিকারের সচেতনতাও সমানভাবে জরুরি। ফুটবলের গণ-উন্মাদনার দিনগুলোয় আমরা যেন ভুলে না যাই, ওএমএসের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে চাল না কিনতে পেরে ফিরে যাওয়া মানুষের মুখগুলো।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক