কেন এত অর্থক্ষুধা, আর কত লাগবে তাঁদের

কয়েক দিন পরপর পত্রিকায় খবর বের হয়, অমুক ব্যক্তি কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ, তমুক ব্যক্তির সহস্রাধিক বিঘা জমি, কয়েক ডজন ফ্ল্যাট, ওই দেশে বাড়ি, সেই দেশে ব্যবসা। এমন শিহরণ জাগানিয়া খবরগুলো বছরের পর বছর বের হলেও এই রাষ্ট্রের সেই সব ফাঁকফোকর বন্ধ হয় না, বরং ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে সম্পদ বাড়ানোর নেশায় মেতেছেন তাঁরা।

হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিদেশে থাকার পরও এই তাঁরা এখন ‘দেশপ্রেমিক’ বর্গা নিচ্ছেন। ভিনদেশে বাড়ি করে নিজের দেশের ভালোবাসা পাতছেন। নিজ এলাকার ভোটাররা বিদেশে চাকরির জন্য হাউকাউ করলেও আমাদের সেই দেশপ্রেমিক সম্প্রদায় সেই দেশে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে, বিদেশিদের নিয়োগ দিচ্ছে।

এমন একটি সোনার বাংলা ‘তাঁদের’ জন্য আশীর্বাদ, অর্থবিত্তের উর্বর তীর্থভূমি। একদল মানুষ বিদেশে গিয়ে মাথার ঘাম পা ফেলে পরিবারের জন্য ‘প্রবাসী আয়’ পাঠানোর লড়াইয়ে মগ্ন, সেখানে আর একদল গোষ্ঠী ক্ষমতার মসনদে বসে নিজেদের পরিবার–পরিজনের জন্য ‘অন্য দেশে’ কিনছে বিলাসবহুল বাড়ি, হোটেল কিংবা খুলছে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা।

আরও পড়ুন

মধ্যপ্রাচ্যের ‘শেখ’ সম্প্রদায়দের ছাপিয়ে আভিজাত্যে এগিয়ে থাকা আমাদের এই সোনার মানুষদের কাঁধেই পড়েছে ‘বাংলাদেশের ভার’। তাঁরা এখন এই দেশের হর্তাকর্তা।

নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা অনেকে যখন ক্ষমতার সংস্পর্শে এসে নিজেদের বলয়ের প্রসারণ যেমন ঘটান, তেমনি তাঁদের দৃষ্টিসীমাও হয় প্রখর। বেতনের টাকায় যেখানে নিজের পরিবার নিয়ে ‘ছাপোষা’ জীবন নির্বাহ করার কথা, সেখানে তাঁদের সন্তানদের টিউশন খরচই রাষ্ট্রের ঘোষিত বেতন কাঠামোর চেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ বেশি। দামি ঘড়ি, ফোন, ল্যাপটপে ভাসাচ্ছেন, চালকসহ কয়েকটি গাড়ি তো থাকছেই। সুযোগ পেলেই কোটি টাকা টিউশন ফি দিয়ে সন্তানদের বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা করছেন।

একদল মানুষের সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসিক হল পায় না, গাদাগাদি করে গণরুমে থাকছে, সেখানে সেসব হর্তকর্তারা ক্লাসের ফাঁকে সন্তানদের বিশ্রামের জন্য আলাদা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থাও করছেন। আবার বিদেশের যেসব এলাকায় এলাকায় তারা আবাসন গড়ে তুলছেন তার অঘোষিত নামকরণ হচ্ছে ‘বেগমপাড়া’।

আরও পড়ুন

বিষয়টি এখন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সম্পদ। কী সরকারি কর্মকর্তা, কী মন্ত্রী-সংসদ সদস্য, কী ছাত্রনেতা; যে যেভাবে পারছেন দেশটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খুবলে খুবলে খাচ্ছেন। মানুষ মারা ঠিকা থেকে আসছে টাকা, চোর ধরা-ছাড়ার মধ্যে থাকছে লেনদেন, চাকরি নিয়োগ, রাস্তাঘাটের দরপত্র থেকে শুরু করে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির গন্ধ অনেকটা গা–সওয়া হয়ে গেছে। ফলে ‘ভালো থাকার’ মন্ত্র এখন অর্থ উপার্জনের যন্ত্রে গিয়ে ঠেকেছে।

তাই সুযোগ নিয়ে, ঘোষণা দিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পকেটে শুধু টাকাই ভরছে না, ‘মূল্যের স্বেচ্ছাচারিতায়’ জিম্মি থাকা মানুষগুলোর গলা কাটা হচ্ছে নিত্যদিন। একই জিনিস পাশের দেশে দাম যেখানে অর্ধেক, সেখানে নিজ দেশে হচ্ছে তিন গুণ কিংবা চার গুণ। ভেজাল দিয়ে আসছে নির্ভেজাল অর্থ।

কোথায়, কীভাবে, কারা অর্থ লুট করায় মশগুল, তা জানা থাকলেও ‘সিন্ডিকেট’–এর কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে মন্ত্রী-উপমন্ত্রীরা নিজেদের দায়িত্ব সারছেন। ফলে সিন্ডিকেটে দ্রব্যমূল্যে সাধারণ মানুষের জীবন এখন ওষ্ঠাগত। বেতন-কাঠামোর সঙ্গে বাজারের উল্লম্ফনে পেরে না ওঠায় আমিষের কাটছাঁট করার খবর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে।

অবৈধ অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হওয়ায় কিছু মানুষের কাছে ‘বাংলাদেশ’ হয়ে উঠছে পৃথিবীর অর্থরাজ্য। যে যেভাবে পারছে, মারছে, গড়ছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, চাই চাই চাই সম্পদ চাই, আরও চাই আরও দিন সম্পদ চাই। অথচ আমরা যাঁরা বিদেশে বাংলাদেশের যেকোনো সরকারি কর্মকর্তার চেয়ে ৫ থেকে ১০ গুণ বেতন পাচ্ছি, তাঁরাও পরিবারের জন্য সীমাহীন পরিশ্রম করছি কেবল একটা সচ্ছল জীবনের জন্য।

ক্ষমতার সংস্পর্শে থাকা কিছু মানুষের ‘অর্থপ্রাপ্তি’ এখন উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়ে যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক এসব উন্নয়নে আমাদের রাষ্ট্রের নীরব থাকা কিংবা সরব থাকা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। টাকার কাছে পরাজিত বিবেক ‘ছটফট’ করলেও দেখার নেই, বলার কেউ নেই।

কিন্তু কেন এটা হবে? কেন ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলোর পরিবার-পরিজনদের অর্থবিত্তের খোঁজখবর রাষ্ট্র রাখবে না, কেন মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুরের মাটি কিনে নেওয়ার পরও সরকারের কিছু করার থাকছে না?

শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান থাকাকালীন কীভাবে সহস্রাধিক বিঘা জমির মালিক হচ্ছেন কিংবা মন্ত্রী থাকা অবস্থায় কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধামাচাপা দেওয়া লাগছে?

কেন পত্রিকার খবরের জন্য তীর্থের কাক হয়ে থাকতে হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনকে? ১২ হাজার ডলারের বেশি অর্থ যখন বিমানবন্দর দিয়ে পার হচ্ছে, কিংবা ব্যাংক থেকে অস্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছে, কেন আমাদের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কাজ করে না?

বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ডলার হয়ে ভিনদেশে হাত-পা গজিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আমরা অনুমোদন দিইনি, আমরা জানি না, অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখব—এমন বালখিল্য দাপ্তরিক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে কৈফিয়ত জাহির হয়।

বিদেশে ১০ ডলারের জিনিস দেশের কাস্টমসে ১৬ সেন্টে দেখিয়ে অর্থ পাচারের যে পুরোনো রুট সচল রয়েছে, কাস্টমস ফাঁকি (কিংবা দোস্তি) করে চলে যাওয়া সম্পদগুলো যখন দেশের বড় ছিদ্র, হুন্ডির দাপটে অর্থ টালমাটাল অবস্থা, তখন আমরা সুখ খুঁজছি উন্নয়নের ছবিতে। মুখ ঢাকছি ধর্মের কলে।

বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে ১০০ টাকার বরাদ্দে ৩৫ টাকার কাজ, সেটিই দেশের উন্নয়ন। ৫০০ টাকার জিনিস যখন ৫০ হাজার টাকায় কেনা হচ্ছে, ১০ লাখ টাকার কাজের জন্য ১০ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন হচ্ছে, তখন তা মূল্যায়নের কেউ থাকছে না।

উচ্চশিক্ষা নিয়ে সেরা ছাত্রটি কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতা হারিয়ে ‘আত্মতৃপ্তি’ পাওয়ার জন্য ‘উপরি ইনকামের’ পথ খুঁজছে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পর্দার অন্তরালে অর্থ-বৈভব অর্জনের একধরনের প্রতিযোগিতা চলছে।

অবৈধ অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হওয়ায় ওই সব মানুষের কাছে ‘বাংলাদেশ’ হয়ে উঠছে পৃথিবীর অর্থরাজ্য। যে যেভাবে পারছে, মারছে, গড়ছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, চাই চাই চাই সম্পদ চাই, আরও চাই আরও দিন সম্পদ চাই। অথচ আমরা যাঁরা বিদেশে বাংলাদেশের যেকোনো সরকারি কর্মকর্তার চেয়ে ৫ থেকে ১০ গুণ বেতন পাচ্ছি, তাঁরাও পরিবারের জন্য সীমাহীন পরিশ্রম করছি কেবল একটা সচ্ছল জীবনের জন্য।

প্রবাসে যাঁরা বাড়ি কিংবা গাড়ি কিনছেন, তাঁরা ব্যাংক লোন ছাড়া এসব কল্পনাও করতে পারেন না। অথচ দেশে তৃতীয় শ্রেণির একজন সরকারি কর্মচারীর থাকছে কয়েকটা ফ্ল্যাট, গাড়ি কিংবা বিদেশে বাড়ি।

অনায়াসে বেতনের ১০ থেকে ১০০ গুণ উপরি ইনকাম করা যায়, যাঁর হিসাব দেশ তো জানবেই না বরং নিজেদের সন্তান জানতে চাইবে না, স্ত্রী জানতে চাইবে না, মা-বাবাও না। সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মচারী–কর্মকর্তা যে নেই তা বলছি না কিন্তু তাঁদের সংখ্যা কম অথবা তাঁদের সংখ্যা বেশি হলেও তাঁরা হয়ে পড়েছেন কোনঠাসা।

আয়করের সঙ্গে ‘প্রকৃত আয়-ব্যয়ের’ স্বচ্ছতা না থাকায় কিংবা ফাঁকফোকর তৈরি হওয়ার সুযোগ নিয়ে অনেকে নিজের ইচ্ছেমতো ‘সম্পদে মাস্ক’ পরিয়ে দিচ্ছেন। পরিবারের উপার্জনক্ষম নয় এমন সদস্যদের কাঁধে সম্পদের পাহাড় ঝুলিয়ে নিজেদের ‘অভাবী’ বানিয়ে সারছেন। স্ত্রীদের চেয়ে গরিব থাকা এই অভাবীরা নির্বাচন করছেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেশসেবা করছেন। পাঁচ বছর পর সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘গুণ’ শব্দটি। সমাজের ফোসকা পড়া এই চেহারাটায় আয়নায় প্রতিচ্ছবি হিসেবে থাকছে ‘বাংলাদেশ’।

প্রতিবছর বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়া সম্পদকামী এই সম্প্রদায়ের দৌরাত্ম্য এখন প্রতিটি দপ্তরে-উপদপ্তরে। ব্যবসার অন্তরালে সিন্ডিকেটের চেহারা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আলো ফেলার জো নেই। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও উন্নয়নের জয়রথ যে গতিতে ছোটার কথা ছিল, তা ক্রমেই মন্থর হয়ে উঠছে। ‘দুর্নীতি’ কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে পুরো বাংলাদেশ। ঘুমিয়ে থাকা রাষ্ট্র, কবে জাগবে? দুর্নীতিবাজদের, সিন্ডিকেটদের পেট থেকে থেকে দেশটাকে বাঁচানোর জন্য দায়িত্ব নেবে কে?

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]