সৃষ্টির আদিকাল থেকেই পৃথিবীর সব প্রান্তে মানুষ খাবারের জন্য সংগ্রাম করে আসছে। যুগ যুগ ধরেই ক্ষুধা আর দারিদ্র্য নিয়ে দেশে দেশে কথা বলা হচ্ছে বা লেখা হচ্ছে। তাই বলে কোনো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম বিপন্ন বা অস্থিতিশীল হচ্ছে না। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা এতটা ঠুনকো নয় যে কোনো কথার জের ধরে দেশ বিপন্ন হবে।
সর্বত্রই স্বাধীন দেশের নাগরিকদের, ক্ষুধা নিয়ে কথা বলার অধিকার আছে। প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত একজন দিনমজুরের মন্তব্য ‘আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ সংবলিত একটি ফটোকার্ড নিয়ে ‘দেশকে অস্থিতিশীল’ করার চেষ্টা বা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে এমন বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। অনেকের অভিযোগ, ওই এক ফটোকার্ডের মাধ্যমে দেশের সম্মানহানি করা হয়েছে। যে বা যাঁরা এই বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছেন বা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব খুঁজছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে অতীত ইতিহাসের কথা বলব।
একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে যখন অসহযোগ আন্দোলন চলেছে, তখন স্লোগানটি প্রথম শুনি— ‘লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়।’ আমাদের শহর রাজশাহীর রাস্তা, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে স্বাধীনতাকামী মানুষদের মিছিলে উত্তাল থাকত। সেই সময় রাজশাহীতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ছোটখাটো বলিষ্ঠ গড়নের কর্মী আবদুর রাজ্জাক আকাশে দিকে হাত ছুড়ে ছুড়ে যখন স্লোগানটি দিতেন, তখন স্বাধীনতাকামী মানুষ আরও উদ্বেলিত হয়ে সমস্বরে তাঁর সঙ্গে গলা মেলাত।
আমরা ছোটরা ভাবতাম, এই স্লোগান নিশ্চয় পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কাছ থেকে আমদানি করা। অনেক পরে জেনেছি, এই স্লোগানের ইতিহাস। ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ কলকাতার মহম্মদ আলী পার্কে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে হিন্দি বলয়ের কর্মীরা প্রথম স্লোগানটি তুলেছিলেন। সেই স্লোগানে কেঁপে উঠেছিল পুরো সম্মেলন। ভারত বিভক্তির সংশয় নিয়েই ‘লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগানটি এসেছিল এবং লোকমুখে জনপ্রিয় হয়েছিল।
‘লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগান দেওয়ার কারণে রাজশাহীর আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে সেই সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার কোনো দেশদ্রোহী মামলা করেনি।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিয়ে সোচ্চার হওয়ার রাজনীতি বা গল্প, কবিতা, উপন্যাস শুধু উপমহাদেশের রাজনীতি বা সাহিত্যে নয়, পাশ্চাত্যেও রয়েছে। ইউরোপের যেকোনো বড় শহরের কেন্দ্রে গেলেই কিছু ক্ষুধার্ত মানুষ বা ভিক্ষুকের দেখা মিলবে। এসব বিপন্ন মানুষকে নিয়ে সরকারের পরিকল্পনায় গাফিলতি আছে বলে পত্রপত্রিকায় হরহামেশা লেখা হয়। তাই বলে এই দেশগুলোতে পত্রিকার সাংবাদিক বা সম্পাদক হয়রানির সম্মুখীন হন না।
অনেক আগে সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পরাধীন দেশের দুঃখ, দুর্দশা ও শোষিত মানুষের কষ্টের কথা লিখতেন। তাঁর কবিতায় উঠে আসত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন তেতাল্লিশের মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসহ সমাজের নানা অসংগতির কথা। তাঁর কলম থেকে রচিত হয়েছিল ‘হে মহাজীবন’ কবিতার একটি কালোত্তীর্ণ লাইন: ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ তিনি বলতে চেয়েছিলেন বা এই পঙ্ক্তি মূল ব্যঞ্জনা হলো, ক্ষুধার্ত মানুষের অব্যক্ত আকুতি।
বাস্তবতা হলো পেটে ক্ষুধা থাকলে রূপময় মোহনীয় পূর্ণিমার চাঁদও যেন ঝলসানো রুটির মতো মনে হয়। কারণ, জঠরের জ্বালা সর্বগ্রাসী। ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে স্বাধীনতা, সাহিত্য বা কবিতা অনর্থক মনে হয়। ‘হে মহাজীবন’ কবিতার সেই কালোত্তীর্ণ পঙ্ক্তি ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ কবিতার জন্য সুকান্ত ভট্টাচার্যকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের রাজরোষে পড়তে হয়নি। উল্লেখ্য, তাঁর কবিতাগুলো রচিত হয়েছিল ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিয়ে সোচ্চার হওয়ার রাজনীতি বা গল্প, কবিতা, উপন্যাস শুধু উপমহাদেশের রাজনীতি বা সাহিত্যে নয়, পাশ্চাত্যেও রয়েছে। ইউরোপের যেকোনো বড় শহরের কেন্দ্রে গেলেই কিছু ক্ষুধার্ত মানুষ বা ভিক্ষুকের দেখা মিলবে। এসব বিপন্ন মানুষকে নিয়ে সরকারের পরিকল্পনায় গাফিলতি আছে বলে পত্রপত্রিকায় হরহামেশা লেখা হয়। তাই বলে এই দেশগুলোতে পত্রিকার সাংবাদিক বা সম্পাদক হয়রানির সম্মুখীন হন না।
নরওয়ের বিখ্যাত লেখক নুট হামসুন, ১৮৯০ সালে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস হাংরি বা ক্ষুধার্ত বইটি লেখেন। লেখক হামসুন ১৮৮৮ সালের গ্রীষ্মে আমেরিকা থেকে জাহাজযোগে কোপেনহেগেন ফেরার পথে প্রায় ক্ষুধার্ত থাকতেন। উপন্যাসটি তিনি জাহাজে বসেই লেখা শুরু করেন। তাঁর ক্ষুধার্ত উপন্যাসে জীবনের নানা ক্ষুধার্ত সময়ের কথা তিনি লিখেছেন। এই লেখকের আরও কিছু উপন্যাস রয়েছে। ১৯২০ সালে লেখক নুট হামসুন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
রোমানিয়ায় বংশোদ্ভূত জার্মান ঔপন্যাসিক হের্টা মুলার। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাশিয়ার বন্দিশিবিরে তাঁর মায়ের ক্ষুধার যন্ত্রণা ও শিবিরের রক্ষীদের দ্বারা বঞ্চনা এবং হয়রানির বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন ‘আটেমশাউকেল’ বা নিশ্বাসের দোলাচল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে হাজার হাজার রোমান-জার্মানদের মতো, হের্টা মুলারের মাকেও রাশিয়ায় বন্দিশিবিরে নির্বাসিত করা হয়েছিল। ঔপন্যাসিক হের্টা মুলার তাঁর মায়ের জঠরের ক্ষুধার যন্ত্রণা ও কষ্টের কথা, শিবিরের লোকেরা কর্তৃক তাঁর মায়ের মূল্যবোধ এবং নৈতিকভাবে অমর্যাদার কথা তাঁর উপন্যাসে ব্যক্ত করেন। নিশ্বাসের দোলাচল বইটি লিখে ২০০৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত একজন দিনমজুরের মন্তব্য ‘আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ সংবাদটি নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা বা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করার কথা যাঁরা বলছেন, আপনারা কি একবার ভেবে দেখেছেন, আপনারা কী বলছেন! যারা বস্তির অধিবাসী, রিকশাচালক বা দিনমজুর, যারা দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত দুবেলা–দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে পারে না, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে তাদের নাভিশ্বাস ওঠে যায়, আর স্বাধীন বাংলাদেশ তারা তাদের সেই কষ্টের কথা বলতে পারবে না? আর সেই কষ্টের কথা সংবাদমাধ্যমগুলো কি প্রকাশ করতে পারবে না?
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
[email protected]