২০২৩ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে আমরা বেশ খারাপ করলাম। ১৯৯৯ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপে গিয়েও তো আমরা পাকিস্তান-স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে জিতে এসেছিলাম। এত দিন পর, ৯ ম্যাচে মাত্র দুটোয় জয়, বাকি সব কটিতে পরাজয় একটা বড় বিপর্যয়।
ক্রিকেট নিয়ে ২০২২ সালে যা লিখেছিলাম, তা থেকে খানিকটা উদ্ধৃতি দিই: ‘১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, এর মূলে ছিল দুটো জিনিস। এক, বহুদিন ধরে তারা অভিন্ন টিম নিয়ে খেলেছে। ফলে, খেলোয়াড়দের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল ভালো। দুই, তারা প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে প্রথম ১৫ ওভারে বেশি রান তুলে খেলার রকমটাই পাল্টে দিয়েছিল।
ব্রাজিলে গিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে জার্মানি যে ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে হারাল, আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো, সেই জার্মান টিম ব্রাজিলের একটা দ্বীপ ভাড়া করে সেখানে বহুদিন একসঙ্গে থেকে অনুশীলন করেছিল। আমাদের ঘরেই আরও ভালো উদাহরণ আছে। ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। আমরা কি ভেবেছিলাম ভারতের মতো দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা? কিন্তু তা-ই হয়েছে। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে আকবর আলীর নেতৃত্বে অসংখ্য প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ দল। একসঙ্গে খেলেছে দীর্ঘদিন।’
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট কেন খারাপ করল, তা আর বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না। আমাদের ক্রিকেট টিমে কারা খেলবেন, কে হবেন অধিনায়ক, আমরা তা-ই জানতাম না; একসঙ্গে অনেক দিন অভিন্ন দল নিয়ে খেলা তো দূরের কথা। আমাদের অধিনায়ক ছিলেন তামিম। তাঁর স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল। আফগানিস্তানের সঙ্গে সিরিজ খেলতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করে ফেললেন তিনি আর অধিনায়ক থাকবেন না। অনুরোধ করে সাকিব আল হাসানকে অধিনায়ক বানানো হলো। বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ড এসেছে বাংলাদেশে, সেই সিরিজে নতুন অধিনায়ক নিজেই থাকলেন না। তাঁকে বিশ্রাম দেওয়া হলো। সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান অধিনায়ক টেলিভিশনে-অনলাইনে হাজির হয়ে বচসা করলেন। এই টিম নিয়ে বিশ্বকাপে ভালো করা যে যাবে না, এটা ১১০ ভাগ বলে দেওয়া যায়। তার মধ্যে ব্যাটাররা কে কোন পজিশনে খেলবেন, তা যেন লটারি করে ঠিক করা হচ্ছিল।
ডেভিড শেংকের লেখা বই দ্য জিনিয়াস ইন অল অব আস-এ সহজাত প্রতিভা বনাম চেষ্টা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বইটা শুরু হয়েছে বেসবলের কিংবদন্তি টেড উইলিয়ামস প্রসঙ্গ দিয়ে। টেড উইলিয়ামস ছিলেন বেসবলের সুপারম্যান, হিটার, বিগ হিটার। অন্যরা মনে করত, এ ব্যাপারে তিনি একটা জিনিয়াস, জন্মগতভাবেই তিনি বলটা অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে দেখতে পেতেন। এটা তাঁর প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতা। কিন্তু টেড উইলিয়ামস বলেছেন, না, প্রতিভা নয়। তিনি বলেছেন, ‘অনুশীলন, অনুশীলন, অনুশীলন। তোমার ভেতরে এই ক্ষমতাটা এনে দেবে অনুশীলন। আমি যে বেশি দেখতে পেতাম, কারণ আমি ছিলাম একাগ্র, এতই ইনটেন্স...আমার বেশি দেখার কারণ ছিল সুপার নিয়মানুবর্তিতা, সুপার দৃষ্টিশক্তি নয়।’
জিনিয়াস হওয়ার সব উপকরণ আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে, জিনিয়াসরা তাঁদের প্রিয় ক্ষেত্রটা বেছে নেন, তারপর সেই বিষয়ে ভয়াবহভাবে অনুশীলন করেন। সাধনা করেন। মনোযোগের চূড়ান্ত প্রয়োগ করেন। ক্রিকেটে ভালো করতে হলে ক্রিকেটেই মন দিতে হবে, ২০০ ভাগ ক্রিকেটে নিমজ্জন ঘটাতে হবে। কবিতায় ভালো করতে হলে চূড়ান্তভাবে কবিই হতে হবে। একটা পঙ্ক্তির জন্য সারাটা জীবন, সারাটা দিন, সমাজ-সংসার, খ্যাতি-অর্থ—সবকিছু পরিত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা কেউই সেই একাগ্রতা, ধ্যান, সাধনার পরিবেশ পান না, সময় তাঁদের সেই অবকাশ দেয় না। এখন হচ্ছে ফাঁকির কাল, শর্টকাটের সময়, ফন্দিফিকিরের মৌসুম। কবিতা না লিখে মতলবের পেছনে ঘোরা বেশি লাভজনক। ভালো শিক্ষক না হয়ে শিক্ষকনেতা হওয়া সিদ্ধি এনে দেয়। নিভৃত গবেষণার তো প্রশ্নই আসে না। ভালো ঔপন্যাসিক না হয়ে টিকটক তারকার ফজিলত বেশি।
ছাত্রনেতারা বড় বড় গাড়ি করে ঘুরছেন, কয়েকটা ফ্ল্যাটের মালিক বনে যাচ্ছেন, পাওয়ার প্ল্যান্ট কিংবা ব্যাংকের মালিক হওয়ার জন্য ধরনা দিচ্ছেন। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার উপায় হিসেবে জনপ্রিয় তারকাদের মনোনয়ন দেওয়ার কৌশল পাশের দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে মাশরাফির মতো সর্বজনগ্রাহ্য ক্যাপ্টেনকে ডেকে এনে পাঁচ বছর আগে ভোটে দাঁড় করানো হয়। সাকিব আল হাসান আগে থেকেই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন, নির্বাচন করার সুযোগ তিনি ছাড়বেন কেন!
একজন একাগ্র সাধক ব্যবসায়ী যখন সৎ উপায়ে নিজের ক্ষেত্রে একটু একটু করে এগোচ্ছেন, তখন তিনি দেখতে পান, ঠিকানা না থাকা ভুয়া প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এই সৎ ব্যবসায়ী নিজের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জনের চেষ্টা কেন করবেন? একটা সময় ছিল, যখন এই দেশের নেতারা জনগণের মুক্তির জন্য নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করতেন; বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর জেল খেটেছেন; বেগম মুজিব ছোট ছোট বাচ্চা আর আসবাবপত্র নিয়ে ঢাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, কেউ তাঁদের বাড়িভাড়া দিতে সাহস পাচ্ছিল না। তাই বলে বঙ্গবন্ধু জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত হননি, বেগম মুজিবও তাঁকে বলেননি, যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
তাজউদ্দীন আহমদ একাত্তর সালে থিয়েটার রোডের বাড়িতে একা একটা চকিতে ঘুমাতেন, নিজের কাপড় নিজে ধুতেন, পরিচারক ছেলেটার জ্বর হলে তার মাথায় তাজউদ্দীন নিজে পানি ঢেলেছেন। আমাদের কমিউনিস্ট নেতা বাবার জমিদারি ছেড়ে চলে এসে সর্বস্ব ত্যাগ করে শোষিতের দলে নাম লিখিয়েছেন, বছরের পর বছর জেল খেটেছেন, কিন্তু আদর্শচ্যুত হননি। আর এখন রাজনীতি আর রাজনীতিবিদের হাতে নেই। সত্যি কথা বলতে গেলে, ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ানই তো নেই। পুলিশের কর্তা, প্রশাসনিক কর্তা, সামরিক কর্তা অবসর নিয়েই ভোটে দাঁড়াচ্ছেন; অবসরের আগে থেকেই রাজনীতিতে তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করছেন; আর বড় বড় ব্যবসায়ী মনোনয়ন-দৌড়ে এগিয়ে থাকছেন।
ছাত্রনেতারা বড় বড় গাড়ি করে ঘুরছেন, কয়েকটা ফ্ল্যাটের মালিক বনে যাচ্ছেন, পাওয়ার প্ল্যান্ট কিংবা ব্যাংকের মালিক হওয়ার জন্য ধরনা দিচ্ছেন। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার উপায় হিসেবে জনপ্রিয় তারকাদের মনোনয়ন দেওয়ার কৌশল পাশের দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে মাশরাফির মতো সর্বজনগ্রাহ্য ক্যাপ্টেনকে ডেকে এনে পাঁচ বছর আগে ভোটে দাঁড় করানো হয়। সাকিব আল হাসান আগে থেকেই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন, নির্বাচন করার সুযোগ তিনি ছাড়বেন কেন!
খবরের কাগজের শিরোনাম হচ্ছে, অমুক ব্যাংকে ভয়ংকর নভেম্বর। শিরোনাম হচ্ছে, ই-বিজনেসের নামে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে প্রতারকেরা পালিয়ে যাচ্ছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষেরা পুরস্কৃত হচ্ছেন তাঁর শিল্পক্ষেত্রে অবদানের জন্য নয়, রাজনৈতিক আনুগত্যের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। এই দেশে নিমগ্ন একাগ্র সাধনার কোনো দাম নেই। কোনো জায়গা নেই। সেই যে কথাটা বলা হয়, পুঁজি যখন গড়ে ওঠে, সেই সময়টা লুটতরাজের কাল। পুঁজি গড়ে উঠলে নিজের স্বার্থেই পুঁজি নিজেকে পাহারা দেয়। সুশাসন আসে। আমাদের এই লুটতন্ত্র, নিপীড়নতন্ত্র, নৈরাজ্যের কাল শেষ হয় না কেন!
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেই চলেছে, তবু ব্যাংক খালি করে নিয়ে যাওয়ার খবর থামছে না কেন! এই অস্থির সময়ে আপনি একাগ্র সাধক পাবেন কী করে! আমাদের এখানে এখন একজন নিমগ্ন সাধক কবি পাওয়া যাবে না, ঔপন্যাসিক পাওয়া যাবে না, পেইন্টার পাওয়া যাবে না, ক্রিকেটারও পাওয়া যাবে না। আমাদের নষ্ট সময় এখানে জিনিয়াস তৈরি হতে দেবে না; বরং জিনিয়াস হয়ে জন্ম নেওয়া মানুষদের নষ্ট করবে। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
যাঁরা প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই পরিবেশ, এই সময়, এই সমাজ, এই শাসন তাঁদের নষ্ট করবে। রাজনীতি যখন রাজনীতিবিদদের হাতে থাকে না, ব্যবসা যখন ব্যবসায়ীদের হাতে থাকে না, খেলা যখন ক্রীড়াবিশেষজ্ঞদের হাতে থাকে না; কবিতা যখন কবিদের হাতে থাকে না; তখন আপনি কোনো বড় সাফল্য ধারাবাহিকভাবে আশা করতে পারেন না। খেলোয়াড় যখন নেতা কিংবা ব্যবসায়ী হয়ে যান, ব্যবসায়ী যখন নেতা হয়ে যান, নেতারা যখন ব্যবসার পেছনে ছোটেন, কর্মকর্তারা যখন রাজনীতি-ব্যবসা-ক্ষমতাচক্রে ভীষণ ব্যতিব্যস্ত, তখন আপনি ভালো কিছুই আশা করতে পারেন না।
এখন চলছে কে কতখানি নষ্ট হতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা! সবচেয়ে বড় নষ্টটির জন্য রয়েছে সবচেয়ে বড় মালাটা।
তবু ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ থেকে বলি:
নষ্ট খেত, নষ্ট মাঠ, নদী নষ্ট, বীজ নষ্ট, বড় নষ্ট যখন সংসার
তখন হঠাৎ কেন দেখা দেয় নিলক্ষার নীলে তীব্র শিস
দিয়ে এত বড় চাঁদ?
...
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক