বাংলাদেশ এক স্ট্যাগফ্লেশন বা নিশ্চলতা স্ফীতিতে পড়েছে। সাধারণত মূল্যস্ফীতি বাড়লে বাজারে নিয়োগ বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশে হয়েছে বিপরীত। আগের সরকার এই জিনিস বিভিন্ন ভুয়া তথ্যের মাধ্যমে আড়াল করে রাখলেও এখনকার সরকার এখনো এই তথ্য স্বীকার করতে দেখা যায়নি। বিবিএস এখনো তাদের আগের ভিত্তিতথ্যের ওপর মূল্যস্ফীতি কমছে দেখিয়েই যাচ্ছে। এই মিথ্যা পরিসংখ্যান যত দিন ঠিক হবে না, আমরা সমস্যার সমাধানে পৌঁছতে পারব না।
বিবিএসের হিসাবে মূল্যস্ফীতি কমেছে। সাধারণ মানুষ কি তা ভাবে? বাস্তবে মূল্যস্ফীতি কমা এই দুই মাসে সম্ভবও না। কেন না? জুনের একটা জন-অবান্ধব বাজেটের পর শুরু হয়েছে আন্দোলন। ফলে জুলাই–আগস্ট দুই মাস বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান তাদের স্বাভাবিক কাজ করতে পারেনি। তারপর এসেছে ভয়াবহ দুই বন্যা এবং একের একের পর এক বিভিন্ন দাবিদাওয়ার আন্দোলন। বন্যার ফলে শুধু ফসলহানির সঙ্গে ভেসে গেছে গবাদিপশু এবং পোলট্রিসহ অনেক খাদ্যের উৎস। এখন যেভাবেই হোক এই দেশে খাদ্যের দাম বাড়বেই। এটা তো গেল বর্তমান প্রেক্ষাপটের কথা। পুরোনো পাপের বোঝা তো এখনো কাটানো সম্ভব হয়নি। সেসব নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক দেখা যাক।
কৃষি খাত: বিগত বছরগুলোতে দেশের কৃষি খাতের উৎপাদন খরচ অস্বাভাবিক বেড়েছে। সারের দাম বেড়েছে, বিদ্যুৎ না থাকায় নির্ভর করতে হচ্ছে ডিজেলের ওপর। কীটনাশক, পশুখাদ্যের খরচ বেড়েছে। আরও বেড়েছে শ্রমিকদের খরচ। ঢাকায় ব্যাটারি রিকশা চালু হওয়ায় গ্রামে এখন শ্রমিক পাওয়াই দায়। আর তার ওপর আছে সিন্ডিকেট, যাদের জন্য কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য (এখানেও তথ্য চুরি) কৃষিজমি কমছে। নিজেরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হলে কীভাবে দাম কমানো সম্ভব? আর এই সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে একজনও কৃষিবিদ নেই। সারের সরবরাহ আর দাম কমিয়ে দেশকে যেকোনো মূল্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।
জলবায়ুর পরিবর্তন: আমাদের জলবায়ু যে ভয়াবহভাবে বদলে যাচ্ছে। ফলে কৃষিতে ফলন ব্যাহত হচ্ছে। অতি গরম, বর্ষা বা শীত উৎপাদনশীলতাও কমিয়ে দিচ্ছে। আগের সরকারের ‘উন্নয়ন আগে’ নীতি পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করে গেছে। এবারের বন্যায় প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন সবজি ও খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়েছে। সবজির দাম তো বাড়বেই। তাহলে হাত–পা ছেড়ে বসে থাকব? অবশ্যই না। অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রজেক্ট বন্ধ করে পরিবেশের জন্য মেগা প্রজেক্ট নিতে হবে। আবাদি জমিতে ঘর বানানো নিষিদ্ধ করতে হবে। আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশন চুক্তিতে স্বাক্ষর, গঙ্গা ব্যারাজের কাজ শুরু, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, খাল-নদী খনন, বন পুনরুদ্ধার এবং গাছ লাগানো প্রকল্প আমাদের আগের বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনার পথে মাইলস্টোন হতে পারে।
শিল্পায়নে কাঁচামালের আমদানি–নির্ভরতা: পাচার করা ১৫০ বিলিয়ন ডলার যদি দেশে বিনিয়োগ হতো, তাহলে কী হতো? দেশের চেহারা পালটে যেত। এই দেশ গার্মেন্ট–নির্ভর। এত বছরেও তাদের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। তাহলে বাকিগুলোর অবস্থা বোঝাই যায়। আমাদের দেশের পাট ভারতে গিয়ে পণ্য হয়ে বিদেশে রপ্তানি হয়। আর আমরা এখনো পলিথিনকে চটের ব্যাগ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারিনি। একটা দেশের যদি সব কিছুই আমদানি–নির্ভর হয়, তাহলে দাম কমাবেন কোন জায়গায়? একবার বস্ত্র খাতের একজন দেখিয়েছিলেন যে দেশে উৎপাদনের থেকে ভারত থেকে আমদানি করে নিয়ে এলে খরচ কম পড়ে। আবার দেশে এত এত চিনিশিল্পের কারখানা, আমাদের কেন চিনি আমদানি করতে হচ্ছে? যেখানে আখচাষিরা হচ্ছেন বঞ্চিত। প্রবাসীদের মতো ছোট ও মাঝারি শিল্পকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে উৎপাদনে কাজে লাগানো যেতে পারে।
পরিবহনে অতিরিক্ত খরচ: আগের সব পুকুরচুরির জন্য দেশের রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ। যদিও এ ব্যাপারে এখনো কোনো প্রকল্প পরিচালক, এলজিইডির কাউকে জবাবদিহি করতে দেখা যায়নি। উপদেষ্টা পরিষদে তো কোনো প্রকৌশলীই নেই, যিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারবেন।
পণ্য, কাঁচামাল ইত্যাদি পরিবহনে প্রতি ট্রাকে চাঁদা দিতে হয়। এর সঙ্গে পুলিশসহ জড়িত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। এই চাঁদা এখনো চলছে বিরামহীন। তেলের দাম বাড়তি। পথে অতিরিক্ত জ্যাম। এই দুটিই কমাতে হবে। বাংলাদেশের বন্দর পৃথিবীর সব থেকে অদক্ষ বন্দর। বন্দরজটের কারণে প্রতিদিন দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের যত দিন সক্ষমতা না হয়, অন্য দেশের পণ্য খালাসের চুক্তি বাতিল করতে হবে। আমাদের লাভ না হলেও অতিরিক্ত খরচের দায় মেটানো লাগছে জনগণকেই। হিমায়িত করে রেল দিয়ে পরিবহন করা যায় কি না, সরকার ভেবে দেখতে পারে। তাহলে চাঁদাবাজি ও খরচ দুটিই কমবে।
সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎপাত: অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে সিন্ডিকেট গা ঢাকা দিয়েছিল। তখন কিছুদিন জিনিসপত্রের দাম কমেছিল। এখন আবার আগের অবস্থায় চলে এসেছে। এই দেশে কয়েক পর্যায়ে সিন্ডিকেট কাজ করে। কৃষকেরা চেষ্টা করলেও সরাসরি বাজারে যেতে পারে না। এরপর আছে বিপণন। যে জন্য ভারত থেকে অর্ধেক দামে ডিম নিয়ে এলেও ডিমের দাম বাড়ছেই। সিন্ডিকেট ভাংতে গেলেই তারা সবাই মিলে বাজার আরও অস্থিতিশীল করে তোলে। এক কারওয়ান বাজারেই তিন হাত ঘুরে আমাদের হাতে পণ্য আসে। এই সিন্ডিকেটকে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের ধরার অনেক উপায় আছে; কিন্তু এর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে; কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেখে মনে হয়, এখনো তারা নিজের কাজ কী সেটি নিয়ে ওয়াকিবহাল না।
অপ্রয়োজনীয় ট্যাক্স ভ্যাট: এবারের বন্যার পর আমাদের খাদ্য আমদানি করতে হবেই; কিন্তু প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ট্যাক্স–ভ্যাট মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাবে। যেমন ডিমের ওপর ট্যাক্স এখন কি প্রয়োজন? অন্তত প্রয়োজনীয় খাদ্যে আমাদের এই ট্যাক্স ভ্যাট কমাতে হবে।
সরকার বৈদেশিক রিজার্ভ নিয়ে অনেক চাপে আছে। হয়তো জানুয়ারি থেকে ঋণগুলো আসা শুরু করলে চাপ কমবে। মূল্যস্ফীতি কমানোর দুটি চিরন্তন তত্ত্ব—ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দাও এবং সুদহার মূল্যস্ফীতির থেকে বেশি করো। দেশ আমদানি–নির্ভর হওয়ার ফলে সরকার চেষ্টা করছে ১২০ টাকায় ডলার স্থির রেখে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের। এখানেই আবার আসে বিবিএস। ঠিক উপাত্ত না থাকায় কী করে বোঝা যে সুদের হার কত বাড়াতে হবে? বেশি বাড়ালে তো বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যাবে। এই দুষ্ট চক্র থেকে বের হতে ‘আউট অব দ্য বক্স’ কিছু করতে হবেই। এখানে দরকার ছিল একজন করপোরেট খাতের মাথা, যারা প্রতিনিয়ত এই সব সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে ব্যবসা চালিয়ে যান।
এদিকে বাজার তদারকির জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছে, তা আগের মতন গতানুগতিক আমলানির্ভর। মধ্যবিত্ত ও গরিবদের জন্য রেশনের দরকার; কিন্তু এই অবস্থায় সরকার কতটা পারবে? মূল্যস্ফীতির টেকসই সমাধানের জন্য দরকার সবার মিলিত চেষ্টা। প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপস্থিতি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ, গবেষক, বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞ। পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে সরকার নিজের চেম্বারে বসে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তাদের যেতে হবে মানুষের কাছে। বাড়াতে হবে জনগণের সঙ্গে সংযোগ। জনগণের অবস্থা উপলব্ধি করলেই শুধু সমাধানের কেন্দ্রে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]