৫ আগস্ট। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার কাছাকাছি। আমি একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায়, গ্রিন রোডের মোড়ে। কানে এল নরম গলার অনুরোধ, ‘একটা লিফট পাওয়া যাবে?’
ফিরে তাকিয়ে দেখি, ডান চোখে কাপড়ের ব্যান্ডেজ বাঁধা অল্পবয়সী একটি মুখ। ছোটখাটো, হালকা-পাতলা ছেলেটার হাতে লাঠিতে বাঁধা লাল-সবুজ পতাকা।
বলল, সায়েন্স ল্যাব যাবে। রিকশায় তুলে নিলাম। রাস্তায় শত শত মানুষের উত্তাল পদযাত্রার চিহ্ন দেখতে দেখতে জানতে চাই, সে কে?
জানলাম, নাম তার শাহেদ—শাহেদুল ইসলাম। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতক পর্যায়ে পড়ছে।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাজপথে লড়েছে সে ১৭ জুলাই থেকে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়, বাড্ডায়, মিরপুরে। অনেক বন্ধুর সঙ্গে এক হয়ে।
৪ আগস্ট বিকেলে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় শাহেদ পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেডের মুখে পড়ে। তার চশমার কাচ ভেঙে ডান চোখে বিঁধে যায়।
জিজ্ঞাসা করি, কোথা থেকে ফিরছে? সে বলে, গণভবনে গিয়েছিল। ভাঙচুর আর লুটপাট দেখে এসেছে। সে কিছু সঙ্গে করে নিয়ে আসেনি?
৬ আগস্ট সকালে ফোন করে জানলাম, এখন ডাক্তারের কাছে গিয়ে চোখ দেখাবে। ভেবেছিল তারপর ফেনীতে মায়ের কাছে যাবে, কিন্তু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আর অন্য সহিংসতার কথা শুনেছে। প্রতিবাদ-প্রতিহত করার কাজ থাকবে। ছেলের ঘরে ফেরার জন্য মাকে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
একটু লাজুক হেসে মাথা নাড়ে—নাহ, তার মন সায় দেয়নি। বলে, ‘আমি চাইলে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার জিনিস নিয়ে আসতে পারতাম। অনেক কিছু ছিল সেখানে, ল্যাপটপ, আরও কত কী!’
একটু থেমে বলে, ‘এখন খুব ভালো লাগছে যে কিছু ধরিনি, তুলে আনিনি।’
আবছা অন্ধকার পথে ছোটখাটো দলে অথবা একা মানুষের এলোমেলো চলাচল। আমাদের ব্যাটারিচালিত রিকশা সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চলে।
রাজপথে শাহেদ কেন নেমেছিল? সে বলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। তার মনের ক্ষোভ আর বিদ্রোহ তাকে ঘরে থাকতে দেয়নি।
রিকশাচালককে সে জিজ্ঞাসা করে, আমাকে নামিয়ে তাকে মিরপুর পৌঁছে দেবে কি না। মধ্যবয়সী চালক রাজি হন।
শাহেদ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বসুন্ধরায় ঘর নিয়ে থাকত। দুটি মামলায় তার নাম উঠেছে শুনে মিরপুর এলাকায় বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকছিল।
আজও সেখানেই যাচ্ছে। চোখের আঘাতটা আছে, বড় ক্লান্ত সে।
ইতিমধ্যে আমার বাসা এসে যায়। আমি পুরো পথের ভাড়া মেটাই। শাহেদ বারবার বলতে থাকে, তার ভাড়া সে দিতে পারবে।
তার চেহারায় ক্লান্তি, কিন্তু চোখমুখ উদ্দীপ্ত, ভয়হীন। ন্যায়বোধের সহজ স্বাভাবিক জোর—সাহস।
ছেলেটার একটি ছবি নিজের মনে ধরে রাখতে ইচ্ছা হলো। তাকে সেটা বলতে সে রাজি হয়। রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ায়, আমি আমার ফোনে ছবি তুলি।
৬ আগস্ট সকালে ফোন করে জানলাম, এখন ডাক্তারের কাছে গিয়ে চোখ দেখাবে। ভেবেছিল তারপর ফেনীতে মায়ের কাছে যাবে, কিন্তু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আর অন্য সহিংসতার কথা শুনেছে। প্রতিবাদ-প্রতিহত করার কাজ থাকবে। ছেলের ঘরে ফেরার জন্য মাকে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
২.
আমার ফোনে ৫ আগস্ট সকালেরও কয়েকটি ছবি ছিল। পরিস্থিতির চাপে অথবা নিজের সাহসের অভাবে সেগুলো রক্ষা করতে পারিনি।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পাড়ায় একটু বেরিয়েছিলাম। একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ফটকের সামনে দেখি এক তরুণ আরেকজনের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধছেন। আশপাশে আরও কয়েকজন ছেলেমেয়ে।
লোকটির শার্ট রক্তে ভিজে গেছে। তাঁর ছবি তুললাম, ভিডিওতে কথা রেকর্ড করলাম। বললেন, মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করেন। আগের দিন তাঁর ছেলেকে আন্দোলনবিরোধীরা বেধড়ক পিটিয়েছে।
তাই তিনি আজ পথে নেমেছিলেন। পথে এই ছেলেদের পান। তাঁর মাথার সামনের দিকে খুব সম্ভব একটা ছররা গুলি লেগেছে।
একটি ছেলে বললেন, তাঁরা শাহবাগ যাচ্ছিলেন। সায়েন্স ল্যাবের মোড়ে পুলিশ বাধা দেয়। ছররা ও রবার বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। দলটি ভেঙে এদিক-ওদিক নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়।
এই বাসার মালিকেরা তাঁদের জন্য ফটক খুলে দিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আমিও ফটকের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। গুনতে চেষ্টা করে দেখি তাঁরা অন্তত ৬০ জন হবেন।
সেখানে আড়ংয়ের কর্মকর্তা একজন মা-ও ছিলেন। বললেন, তাঁর স্বামী এ-লেভেল পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে আসবেন। হঠাৎ আট-দশজন পুলিশ সদস্য ঢুকে পড়লেন। তাঁরা যাঁকে পারলেন জড়ো করলেন।
আমার হাতে ফোন দেখে জোর করে ছিনিয়ে নিলেন। অনেক কথা চালাচালি করে ফোনটা ফেরত পেলাম। কিন্তু প্রতিটি ছবি মুছে রিসাইকেল বিন খালি করতে হলো।
পরে জানতে পেরেছি, ছেলেমেয়েদের সবাইকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। কেউ এরই মধ্যে আশপাশের বাসাগুলোতে আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন। দুপুর নাগাদ জানলাম, তাঁরা শাহবাগে যাচ্ছেন।
৩.
৫ আগস্ট দুপুর তিনটার দিকে কারওয়ানবাজারে আমার কর্মস্থল প্রথম আলোর দিকে রওনা হই ব্যাটারিচালিত এক রিকশায়। চালক প্রবীণ। তিনি বলছিলেন, ‘হাসিনা পলাইসে’, ‘এতগুলি পোলাপানেরে মারসে’—ইত্যাদি ইত্যাদি।
মিরপুর রোডে উঠে দেখি স্রোতের মতো মানুষ সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে চলেছে। বেশির ভাগই তরুণ। তাদের পোশাক, শরীরের ভাষা নানা রকম। তবে বাঁধ ভাঙার আনন্দ, উল্লাস স্পষ্ট করে টের পাই।
সোনারগাঁওর মোড়ে একজন এসে হাত মিলিয়ে বলেন, ‘আমরা স্বাধীন হলাম।’
এয়ারপোর্ট রোডে ফার্মগেটমুখী মানুষের ঢল। রিকশা ছেড়ে হেঁটে মিছিল পেরিয়ে ওপারে গেলাম। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতে বললেন, গণভবন যাচ্ছেন।
দাঁড়িয়ে মানুষ দেখি। মানুষ আর শেষ হয় না। চারদিকে নানা স্লোগানের সম্মিলিত শব্দ অন্য সবকিছু ঢেকে দিচ্ছে।
৪.
প্রতিবাদ, ক্ষোভ, ঘৃণা আর বিদ্রোহের জন্ম মানুষের মনে। সেটা যখন জমতে থাকে, তার প্রকাশে কোনো শৃঙ্খলা কি আর আশা করা যায়? সেটাতেই আমার ভয় করে।
৫ আগস্ট সন্ধ্যায় হঠাৎ দেখা দুজন প্রবীণ বললেন, মানুষের মনের ক্ষোভের সঙ্গে একাত্ম বোধ করার কথা। কিন্তু তাঁদের একজন সামনে কী হবে, তা নিয়ে ভয়ও করছেন।
অন্য একজন কথায় কথায় বললেন, পরাজিত সরকার গত দেড় দশকে যা করেছে, তারা তার প্রতিফল পেয়েছে। কিন্তু ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া বাড়িটিতে আক্রমণ হলে তাঁর বুক ভেঙে গেছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
গত কয়েক দিন আমি যেখানে পেরেছি ঘুরেছি আর মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। ক্ষোভ, ক্রোধ আর ঘৃণার নানা রকম বহিঃপ্রকাশ ছিল সবচেয়ে বেশি। অনেকের কথায় মনে জমা থাকা বেদনা, দুঃখকষ্ট আর বঞ্চনা অনুভব করা গেছে।
আমার বয়স ষাটের কোঠায় চলে গেছে। আমি আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণদের বোঝার তাগিদ ভেতর থেকে অনুভব করছি। যেটুকু বুঝেছি, তাঁদের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে তাঁরা মানবেন না।
আমি নিজে যেকোনো উন্মত্ততা, সহিংসতা, জোর-জবরদস্তি, জুলুম আর প্রতিশোধের স্পৃহাকে ভয় করি। আমি এগুলো নিতে পারি না, মানতে পারি না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দু-একজনের সঙ্গে পাকেচক্রে কথা বলতে পেরেছি—হাসপাতালে আর পথে। পত্রপত্রিকা-টিভিতে তাঁদের কথা শুনছি।
তাঁদের কথায় আমি আস্থা পেয়েছি, পাচ্ছি। পরিণত, যুক্তিসংগত, মানবিক কথা। সেটাতেই আশা রাখি, ভরসা করি।
কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা সাংবাদিক