আমরা যখন জীবনের সঙ্গে শিক্ষাকে মেলানোর কথা বলি, তখন সাধারণত আমরা কর্মমুখী শিক্ষাকে বোঝাই, অথবা কোনো কাজ করতে করতে কোনো কিছু শেখাকে বোঝাই। এই দুই ক্ষেত্রেই শিক্ষাকে জীবনের সঙ্গে মেলানোর একটা চেষ্টা থাকে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে এই দুটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তবে আমরা এখানে যে বিষয়টি আলোচনা করব, তা একটু ভিন্ন। আমরা এখানে যেটা বলার চেষ্টা করব, সেটা হচ্ছে শিক্ষাকে কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে তার সঙ্গে শিক্ষার্থীর জীবনের একটা যোগসূত্র তৈরি করতে হয়।
শিক্ষার্থী যদি কোনো কিছু শেখার সময় সেটা তার যাপিত জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতে পারে, কেবল তাহলেই সেটা তার মনে গেঁথে যায়। নচেৎ সেই অধীত বিদ্যা কেবলই কথার ফুলঝুরি হয়ে কিছুদিন পর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য যে ম্যানুয়াল তৈরি করা হয়েছে, সেখানেও বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু শিক্ষকেরা শেষ পর্যন্ত কতটুকু এবং কী মানের প্রশিক্ষণ পান এবং তা কতটা বাস্তবায়ন করেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। মূলত তার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের শিক্ষা কতটা জীবনঘনিষ্ঠ বা টেকসই হবে
যে কেউ তাঁর শিক্ষাকালীন স্মৃতি ঘেঁটে সেটা বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এই কথার সত্যতা খুঁজে পাবেন। তবে এ ক্ষেত্রে গবেষণালব্ধ প্রমাণেরও অভাব নেই। শুধু শিক্ষাশাস্ত্রে নয়, মনোবিজ্ঞানেও এর প্রমাণ মিলেছে। ১৯৬০-এর দশকে হাওয়ার্ড লেভেনথো নামের একজন সামাজিক মনোবিজ্ঞানী তাঁর গবেষণার অংশ হিসেবে টিটেনাস টিকা নেওয়ার জন্য ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজি করানোর চেষ্টা করলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের দুই ভাগে ভাগ করে তাঁদের সাত পৃষ্ঠার একটি বুকলেট দিলেন। সেই বুকলেটে টিটেনাস হলে কী সমস্যা হয়, সেটা লেখা ছিল, টিকা নেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বলা ছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয় যে সব শিক্ষার্থীর জন্য বিনা মূল্যে টিকার ব্যবস্থা করেছে এবং সেটা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই দেওয়া হবে, সেসব বিষয়েরও বিশদ বর্ণনা ছিল।
তবে তিনি এক দলের বুকলেটে টিটেনাস হলে কী হবে, সেটা বোঝানোর জন্য ভয়ংকর সব রঙিন ছবি ও বাক্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। আর অন্য দলের বুকলেট থেকে ছবি বাদ দিয়ে, নরম ভাষা ব্যবহার করে টিকা নেওয়ার জন্য সাদামাটা আহ্বান জানালেন।
ফল যা হওয়ার তা-ই হলো। বুকলেটটি পড়ার পর শিক্ষার্থীদের যখন প্রশ্নমালা দেওয়া হলো, ভয় পাওয়া শিক্ষার্থীরা অন্য দলের শিক্ষার্থীদের চেয়ে টিটেনাসের গুরুত্ব অনেক বেশি অনুভব করল এবং টিকা নেওয়ার ব্যাপারে উদ্গ্রীব হয়ে উঠল। কিন্তু বাস্তবে এই আগ্রহের কোনো প্রভাব পড়তে দেখা গেল না। এক মাস পর লেভেনথো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে খবর নিয়ে দেখলেন, শিক্ষার্থীদের টিকা নেওয়ার হার মাত্র ৩ শতাংশ। বুকলেট পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে সম্মত হলেও পরবর্তী সময় তারা ওই টিকার বিষয় আর মাথায় রাখতে পারেনি।
লেভেনথো বুকলেটের লেখাগুলো আবার ভালো করে দেখলেন। সেখানে তথ্যের কোনো ঘাটতি নেই। ভয় দেখানোর উপাদানেরও কোনো কমতি নেই। তাহলে সেখানে নিশ্চয়ই এমন কিছু নেই, যা থাকলে শিক্ষার্থীরা টিকার কথা ভুলে যেত না। তিনি নিরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করলেন।
এবার বুকলেটে ক্যাম্পাসের একটা ম্যাপ জুড়ে দিয়ে সেখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিকে গোল দাগ দিয়ে চিহ্নিত করে দিলেন; সঙ্গে টিকা দেওয়ার সময়টাও থাকল। এতে কাজ হলো। এবার শিক্ষার্থীদের টিকা নেওয়ার হার বেড়ে ২৮ শতাংশ হলো। আরও একটা মজার ঘটনা ঘটল। টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘ভয় পাওয়া’ও ‘ভয় না পাওয়া’ দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
কিন্তু ম্যাপ দেখানোতে কী লাভ হলো? শিক্ষার্থীরা তো আগে থেকেই জানত, তাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রটা কোথায়! লেভেনথো আসলে ম্যাপের মাধ্যমে কোনো বাড়তি তথ্য যুক্ত করতে চাননি। তিনি কেবল ম্যাপ দিয়ে বুকলেটের চরিত্র পাল্টে দিয়েছেন। আগে বুকলেটটা অন্য দশটা টেক্সটের মতো নিতান্ত একটা একাডেমিক টেক্সট ছিল।
কিন্তু এবার ম্যাপ এবং তার সঙ্গে একটা টাইম টেবিল থাকাতে শিক্ষার্থীরা তাদের দৈনন্দিন রুটিনের ভেতর টিকা নেওয়ার সময়টা ঢুকিয়ে নিতে প্ররোচিত হলো। এভাবে টিকাবিষয়ক একটা নিরেট একাডেমিক নথি তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিষয়ক নথিতে পরিণত হলো। আগের একাডেমিক নথিটা ক্ষণস্থায়ী ও অকার্যকর হলেও এবারের ব্যক্তিগত নথিটা তাদের অনেককেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে নিয়ে গেল।
আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন নিরেট একাডেমিক টেক্সট পড়ে, তখনো এই একই ধরনের ঘটনা ঘটে। যেসব টেক্সট শিক্ষার্থীরা নিজেদের জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারে না, সেগুলো তাদের মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। তবে পরীক্ষাটা তাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে সেগুলো কেবল পরীক্ষা পর্যন্ত টেকে। কিন্তু পরীক্ষার পর সেই অধীত বিষয়গুলোর প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে গেলে সেগুলো ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়।
একাডেমিক টেক্সটের সঙ্গে জীবনের যোগসূত্র খুঁজে বের করার কাজটি তিনভাবে হতে পারে। প্রথমত, যাঁরা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেন বা টেক্সট বই লেখেন, তাঁরা যোগসূত্রটি স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারেন। দ্বিতীয়ত, একজন শিক্ষক যেহেতু তাঁর শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তাদের প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গে পঠিত বিষয়ের সম্পর্কটি সামষ্টিকভাবে তো বটেই, এমনকি একেবারে ব্যক্তিগতভাবেও ধরিয়ে দিতে পারেন। তৃতীয়ত, শিক্ষার্থী নিজে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পালন করতে পারে।
সে যদি জানে যে সে যা পড়ছে বা করছে, তার সবই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং তাকে যদি বলা হয়, সম্পর্কটা খুঁজে বের করাও তার শিক্ষার একটা অংশ, তাহলে শিক্ষাজীবনে তো বটেই, সারা জীবন ধরে সে যা পড়বে বা শিখবে, তার সঙ্গে তার জীবনকে মেলানোর চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ, সারা জীবন ধরেই সে সময় ও শ্রমের বিপুল অপচয় রোধ করতে পারবে।
২০২৩ সালে যে নতুন শিক্ষাক্রম আসছে, সেখানে এ বিষয়ে নজর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য যে ম্যানুয়াল তৈরি করা হয়েছে, সেখানেও বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু শিক্ষকেরা শেষ পর্যন্ত কতটুকু এবং কী মানের প্রশিক্ষণ পান এবং তা কতটা বাস্তবায়ন করেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। মূলত তার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের শিক্ষা কতটা জীবনঘনিষ্ঠ বা টেকসই হবে।
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের মহাপরিচালক