১৬ জুলাই দুপুরে পুলিশের উপর্যুপরি ছোড়া ছররা গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হয়। পুলিশের গুলি ছোড়া এবং আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও ফুটেজ বিভিন্ন টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করেছে। দেশ ও দেশের বাইরের মানুষ এই ভিডিও ফুটেজ দেখেছে। কাউকে বলতে শুনিনি আন্দোলনকারীদের গুলি ও ইটপাটকেলে নিহত হয়েছে আবু সাঈদ।
অথচ ১৭ জুলাই পুলিশের দায়ের করা মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) এ কথাই লিখেছেন মামলার বাদী। এই ভিডিও কি মামলার বাদী দেখেননি? তিনি এমন একটি এফআইআর দিলেন কী করে?
কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জীবন দিয়েছে আবু সাঈদ। দুই দিকে হাত সম্প্রসারিত করে দাঁড়িয়েছিল আবু সাঈদ। পুলিশ গুলি চালায় তার দিকে। পায়ের দিকে নয়, মাথা-মুখ-বুক-পেটে ছুড়েছে সেই গুলি। কেবল তা–ই নয়, যখন তার বন্ধুরা সাঈদকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনো গুলি বন্ধ হয়নি।
এত প্রকাশ্যে অগণিত মানুষের সামনে পুলিশের করা গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনাকে এড়িয়ে যে এফআইআর দেওয়া হয়েছে, তাতে সবাই স্তম্ভিত। পুলিশ যে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তারা কী করতে পারে, সেই আশঙ্কাও এখন বদ্ধমূল। সন্তানহারা মা–বাবা তথা দেশবাসী কি আবু সাঈদ হত্যার বিচারটুকুও পাবেন না?
১৬ জুলাই মঙ্গলবার দিবাগত রাত প্রায় দুইটার সময় আবু সাঈদের মরদেহ নিয়ে তাদের বাড়িতে পৌঁছালে তার ছোট বোন আমার হাত ধরে করুণ আর্তনাদ করে বলছিলেন, ‘স্যার, একনা কইনেন হয় পুলিশকে, হামার ভাইটাক না মারিল হয়। হামার চাকরি না নাগিল হয়।’ আবু সাঈদের মা পাগলপ্রায়। সন্তানের মরদেহ যখন গোসল করানো হচ্ছিল, সেই সময়ে মরদেহের পাশে বসে বলছিলেন, ‘চাকরি নাগিল না হয়, বাঁচি থাকিল হয়। সাঈদ রে ওরে সাঈদ রে...!’
আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন কখনো কাঁদছেন, কখনো পাথরের মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকছেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে অসহ্য বেদনা। তাঁর দিকে তাকানোই যাচ্ছিল না। আন্দোলনকারীরা তাঁর নামে বদলে দিয়েছেন পার্কের মোড়ের নাম।
এখন থেকে ওই মোড়ের নাম আবু সাঈদ চত্বর। যে গেটের সামনে আবু সাঈদ গুলবিদ্ধ হয়েছে, সেই গেটে লিখে দিয়েছে আবু সাঈদ গেট। আবু সাঈদরা মারা যায় না। জাতি তাদের কাছে শেখে, অনন্তকাল শিখবে।
যেদিন আবু সাঈদ মারা যায়, ওই দিন দুপুরে রংপুরের পুলিশ কমিশনারকে অনুরোধ করতে ফোন করেছিলাম—আন্দোলনকারীদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে নজর রাখতে।
আবু সাঈদের ছিল অবর্ণনীয় কষ্টের জীবন। ৯ ভাইবোনের একজনেরও আর্থিক সচ্ছলতা নেই। কেউ পোশাক কারখানায় সামান্য কর্মী। কেউ ভ্যান চালান। তার বাবার সামান্য জমি আছে। আবু সাঈদের থাকার মতো আলাদা ঘরও ছিল না। বাবা মকবুল হোসেন জমি বিক্রি করে ঘরের কাজ করছিলেন। সেই ঘরে আবু সাঈদের থাকা হলো না।
পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সেদিন কয়েকবার কথা হয়। তিনি বারবার আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। ফোন চলাকালে রবীন্দ্রগবেষক ও সংস্কৃতিকর্মী ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য মুঠোফোনে জানালেন, আমাদের একজন শিক্ষার্থী গুরুতর অসুস্থ হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিনজন শিক্ষক উমর ফারুক, নূরুল্লাহ ও শাহীনুর রহমান আমার সঙ্গে ছিলেন। চারজন মিলেই আমরা হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা করি।
যেতে যেতেই আরেক প্রগতিবাদী সংস্কৃতিকর্মী কলেজশিক্ষক কাফি সরকার আর্দ্রকণ্ঠে জানালেন, ‘গুরুতর অসুস্থ শিক্ষার্থী মারা গেছে।’
সে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম আবর্তনের একজন শিক্ষার্থী। স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষা শেষ করেছে। তার বাড়ি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায়। সে কোটা সংস্কারের জন্য গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রংপুরের অন্যতম সমন্বয়ক ছিল।
আমরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছাতেই দেখি শিক্ষার্থীদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে সেখানকার পরিবেশ। শিক্ষার্থীরা মরদেহ স্ট্রেচারে নিয়ে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে রওনা করে। হাসপাতালের তিনতলায় সার্জারি ওয়ার্ডে ঢুকে দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১০০ শিক্ষার্থী, যাদের অর্ধেক ছররা গুলিতে অসুস্থ।
হাসপাতালে আবু সাঈদের বড় ভাই রমজানসহ আমরা লাশের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় ফোনে রমজান আলীকে কেউ বলছিলেন, রাতেই লাশ দাফন করতে হবে। উত্তরে রমজান আলী চিৎকার করে বলছিলেন, ‘কখন লাশ দাফন হইবে হামরা বুঝমো। হামার ভাই মরছে, কখন মাটি দেমো, সেটা হামরা বুঝমো।’
পোস্টমর্টেম করে রাত প্রায় ১২টার সময়ে সাঈদকে নিয়ে রওনা করি। যাওয়ার সময়ে ম্যাজিস্ট্রেট এবং অনেক পুলিশ ছিল। সরকারের গোটা দশেক গাড়ি ছিল। মরদেহ নিয়ে যেতে পীরগঞ্জ বাজার পার হয়ে একটি পেট্রলপাম্পে প্রায় আধা ঘণ্টা দেরি করা হয়। গাড়ির বিশাল বহর গিয়ে বাড়ি থেকে কয়েক শ গজ দূরে জাফরপাড়া বাজারে দাঁড়ায়।
রংপুর থেকে যাওয়া সরকারি একজন ব্যক্তিকেও দেখলাম না রাতে সাঈদের বাড়িতে গিয়ে সান্ত্বনা দিতে। তাহলে এই বিশাল বহরের কী প্রয়োজন ছিল? বরং এসব আনুষ্ঠানিকতার কারণে সাঈদের মরদেহ বাড়িতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়েছে।
আবু সাঈদের ছিল অবর্ণনীয় কষ্টের জীবন। ৯ ভাইবোনের একজনেরও আর্থিক সচ্ছলতা নেই। কেউ পোশাক কারখানায় সামান্য কর্মী। কেউ ভ্যান চালান। তার বাবার সামান্য জমি আছে। আবু সাঈদের থাকার মতো আলাদা ঘরও ছিল না। বাবা মকবুল হোসেন জমি বিক্রি করে ঘরের কাজ করছিলেন। সেই ঘরে আবু সাঈদের থাকা হলো না।
সাঈদের এক বন্ধুর কাছে জানলাম, কখনো কখনো অর্থের অভাবে আবু সাঈদের মেসে মিল বন্ধ থাকত। বাড়ি থেকে কোনো টাকাই দিতে পারতেন না বাবা। আবু সাঈদের জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল, এখন সে অনন্ত ঘুমে, মাটি ও মহাকালের অংশ। বীরের আসনে সে অধিষ্ঠিত।
পুলিশ মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে যা-ই লিখুক না কেন, সচেতন নাগরিকমাত্রই দেখেছেন কীভাবে নিহত হয়েছে আবু সাঈদ। আমরা আশা করছি, তদন্তে প্রকৃত সত্য তুলে আনা হবে। এত প্রকাশ্য ঘটনাকে যদি আড়াল করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে দেশজুড়ে অন্যান্য হতাহতের কি ন্যায়বিচার হবে?
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক