আশুরা ও কারবালা করুণ ইতিহাসের স্মারক

মহররম, আশুরা ও কারবালা—এই তিনটি শব্দের মধ্যে আছে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক। মহররম পবিত্রতা, মর্যাদা, সম্মানের প্রতীক। আশুরা পূর্ণতাপ্রাপ্তি ও সফলতার প্রতীক; আর কারবালা ত্যাগ–তিতিক্ষা, বিপদ–আপদ ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রতীক।

১০ মহররম ৬১ হিজরি (১০ অক্টোবর ৬৮০ সাল) শুক্রবার কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাসুল (সা.) এর আহলে বাইতের সদস্য হজরত হোসাইন (রা.) ও তাঁর ৭২ জন সঙ্গীর বিরুদ্ধে ইবনে জিয়াদ চার হাজার সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে হোসাইন (রা.)–এর একমাত্র ছেলে জয়নুল আবেদিন ছাড়া পরিবারের শিশু, কিশোর, তরুণসহ সব পুরুষ সদস্য শাহাদত বরণ করেন। এ ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এর সঙ্গে জড়িত সবাই আল্লাহর গজবে পতিত হয়।

‘কারবালা’ ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রান্তর। কারবালার ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম বিয়োগান্ত ঘটনা। ‘কারব’ মানে সংকট, ‘বালা’ মানে মুসিবত। তাই কারবালা সংকট ও মুসিবতের উদাহরণ। কারবালার এই হৃদয়বিদারক ঘটনা মহিমাময় মহররম মাসের ঐতিহাসিক মহান আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় এতে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। এতে এই শাহাদতের মাহাত্ম্য যেমন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি আশুরা পেয়েছে ইতিহাসে নতুন পরিচিতি। তাই আজ আশুরা ও কারবালা সমার্থক ও একে অন্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কুফার সুপ্রাচীন নদী ফোরাতের কূলে কারবালার প্রান্তরে যখন হোসাইন (রা.)-এর কাফেলা অবস্থান করছিল, তখন তাদের পানির একমাত্র উৎস ছিল নদীটি উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনী ঘিরে রেখেছিল। তারা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল নিরস্ত্র অসহায় আহলে বাইতকে। এই নদী থেকে পানি সংগ্রহ করতে গেলে দুগ্ধপোষ্য শিশু আলী আসগর এক ফোঁটা পানির জন্য সীমারের বাহিনীর তীরের আঘাতে শহীদ হন। সেদিন ফোরাত কূলে যে ‘পানি পানি’ বলে মাতম উঠেছিল, তা অবর্ণনীয়।

‘কুফা’ ইরাকের একটি বিখ্যাত শহর। হজরত আলী (রা.)–এর শাসনামলে খেলাফতের রাজধানী। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও প্রথম তিন খলিফার সময় মুসলিম শাসনের রাজধানী ছিল মদিনা মুনাওয়ারা। কুফার লোকজন ইয়াজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিদে হোসাইন (রা.)–কে বহু পত্রের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানান। তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি সেখানে গেলে তাঁরা তাঁকে একাকী বিপদের মুখে ফেলে নিজেরা নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে।

‘দামেস্ক’ বর্তমানে সিরিয়ার রাজধানী। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)–এর শাহাদতের পর হাসান (রা.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং ছয় মাস খেলাফতের দায়িত্ব পালন করে সিরিয়ার গভর্নর মুআবিয়া (রা.)–এর কাছে খেলাফতের ভার অর্পণ করেন।

মুআবিয়া (রা.) প্রশাসনিক সুবিধার্থে রাজধানী দামেস্কে স্থানান্তর করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইয়াজিদ ক্ষমতাসীন হলে এর রাজধানী দামেস্কেই রয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে কালক্রমে ইসলামি খেলাফতের রাজধানী তুরস্ক ও মিসরে স্থানান্তরিত হয়েছিল।

‘কারবালা ময়দান’ আজ অসহায়ত্ব ও সংকটের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনুরূপ প্রতিটি সংকটের মুহূর্ত কারবালাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘ফোরাত নদী’ দয়ামায়া ও সহমর্মিতার অনুভূতি চাঙা করে; সব গ্লানি ধুয়ে মুছে করুণার সিন্ধুতে করুণা বারিধারা প্রবাহিত করে। ‘কুফা’ অনন্তকালের জন্য নীতি–নৈতিকতার জয়গান করে, মানবতা ও সুকুমারবৃত্তির অনুকম্পন সৃষ্টি করে সব অবদমিত অন্তরে অবচেতন মনে।

● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম