তীব্র দাবদাহের পর অবশেষে পাহাড়ে শান্তির বারি বর্ষিত হয়েছে। শীতল-স্নিগ্ধ পরিবেশ। রুক্ষ-রুষ্ট পাহাড় হয়ে উঠেছে সবুজাভ। আসলে পাহাড়ের সৌন্দর্য ধরা দেয় বর্ষাকালে বা বৃষ্টির মৌসুমে। কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি। চারদিকে সবুজ পত্রপল্লবের সমারোহ। ফটিকছড়ি পার হতেই খাগড়াছড়ির প্রবেশদ্বারে এমন দৃশ্যে নয়ন জুড়াল। পথে পথে মুগ্ধতা। গুইমারা বিজিবি হাসপাতাল লাগোয়া পাহাড়ের গায়ে বড় হরফে ভেসে উঠেছে অমৃত বাণী, ‘শান্তি সম্প্রীতি উন্নয়ন’।
সারা দেশের মতো উন্নয়নের ছোঁয়া পাহাড়েও লেগেছে ঠিক। জালিয়াপাড়া থেকে সিন্দুকছড়ি-মহালছড়ি হয়ে চার লেনের সড়ক চলে গেছে রাঙামাটির পথে। পাহাড়ের সৌন্দর্যের পোস্টারখ্যাত দুর্গম সাজেকে কয়েক বছর আগেই পৌঁছেছে বিদ্যুৎ। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, ইংলিশ টয়লেট, গরম জল আরও কত-কী। যদিও প্রকৃতি কিছুটা ঢাকা পড়েছে রিসোর্ট আর দোকানের ভিড়ে; তবু পাহাড়ের এগিয়ে যাওয়ারই কথা। হয়তো এগিয়েছে। কিন্তু শান্তি ও সম্প্রীতি? পাহাড়ি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবনমান ও শিক্ষার কতটা উন্নয়ন হয়েছে? সঠিক জবাব পেতে অন্তঃপুরে কান পাততে হবে।
শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে পানির কষ্ট, অবর্ণনীয় ভোগান্তি, সেটা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। এ ছাড়া খাবারের কষ্ট, ফলনের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কষ্ট, আরও হরেক রকম কষ্ট আছে। কষ্টের ফেরিওয়ালা যেন পাহাড়ের প্রতিটি মানুষ। পাশাপাশি সমতলের আগন্তুকদের বাড়তি চাপও সামাল দিতে হচ্ছে পাহাড়কে। পাহাড়ে যারা স্থায়ী বন্দোবস্তি করতে যাচ্ছে, তাদের নিয়েই পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের যত যন্ত্রণা। সম্প্রতি প্রকাশিত সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী, খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী-বাঙালি অনুপাত ৪৯ ও ৫১। বান্দরবানে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা মাত্র ৪১ শতাংশ। তবে রাঙামাটিতে এখনো অগ্রগামী তাঁরা, ৫৭ শতাংশ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী-বাঙালি বিরোধ নতুন নয়। ২০০৮ সালে একবার খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে রক্ত ঝরেছিল। এর আগে-পরে রামগড়, সদর উপজেলা, মহালছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় বিরোধের আঁচ লেগেছিল। বিভিন্ন সময় রাঙামাটি ও বান্দরবানেও উত্তাপ ছড়িয়েছে। এর ফাঁকে অবশ্য ২০১৫ সাল থেকে পাহাড় অস্থির হয়ে পড়েছিল আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ নিয়ে, ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে। বড় কয়েকটি ঘটনার মধ্যে খাগড়াছড়ি স্বনির্ভরপাড়া হত্যাকাণ্ড, নানিয়ারচরের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা, পরবর্তী সময়ে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রধান তপনজ্যোতিসহ পাঁচ হত্যাকাণ্ড এবং বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী গাড়িতে ব্রাশফায়ার এখনো ভোলেননি পাহাড়ের মানুষ; সমতলও।
পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষও খুশি এমন উন্নয়নে। কিন্তু বারবার প্রশ্ন আসে, শান্তি ও সম্প্রীতির কী হবে? মুখে মুখে সম্প্রীতি ও শান্তির জয়গানে আর মজতে চায় না তাঁরা। এই জয়গানের সঙ্গে আপস করে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর একটা অংশ দিন দিন দুর্গম পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। জনসমাগম ও জনরোষ এড়াতে কেবল দুর্গম অরণ্যে বসত গড়ছে। কোথায়, কখন শান্তি আসবে? কখন ফিরে পাবে ভূমির অধিকার? এমন প্রশ্নে নিরুত্তর।
এসব তাণ্ডবের মধ্যে জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে একটা অলিখিত সমঝোতা হয়েছিল। দুই দলই বিরোধী বিদ্রোহী দলগুলোর কারণে কাছাকাছি আসতে পেরেছিল। সেই সমঝোতা বেশি দিন টেকেনি। এখন নতুন করে দুই দল মুখোমুখি অবস্থানে। সর্বশেষ দুই সপ্তাহ আগে লংদু সীমান্তে দুপক্ষের বন্দুকযুদ্ধের খবর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্যে ২ সেপ্টেম্বর গুইমারায় অংথুই মারমা নামের এক ইউপিডিএফ নেতাকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। এর প্রতিবাদে পরদিন আধা বেলা অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয় পাহাড়ে। যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। তবে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য জেএসএসকে নয়, দলটির পক্ষ থেকে দায়ী করা হয় মুখোশধারী দুর্বৃত্তদের।
কুকিচীন নামে নতুন দলের আবির্ভাব ঘটেছে। নাথান বম তাদের নেতা। আগমনের বার্তা ঘোষিত হয়েছে বিলাইছড়িতে তিনজনের রক্তপাতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব সক্রিয় বান্দরবানের রুমাতে জন্ম নেওয়া নতুন এই দল। বিলাইছড়ি হত্যাকাণ্ডের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সভাপতি গৌতম দেওয়ান মুঠোফোনে প্রশ্ন তুলেছেন এভাবে, কার জন্য, কার অধিকারে বারবার হত্যা? তাদের শিকড় কোথায়? সংকট সমাধানের পথে গেলেই নতুন করে সংঘাত, কেন?
পাহাড়ি নেতারা একবার সমঝোতা করে আড়াই বছর সংঘাতহীন রেখেছিলেন পাহাড়কে। কিন্তু ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের জন্মের পরপরই আবার সবুজ পাহাড়ে রক্তের দাগ লাগতে শুরু করেছে। এসব কারণে আতঙ্কে থাকে পাহাড়ের মানুষ। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গত তিন বছরে নতুন কোনো সভা করতে পারেনি। সর্বশেষ ৭ সেপ্টেম্বর রাঙামাটিতে সভা ডেকেও একটি গোষ্ঠীর অবরোধের হুমকিতে স্থগিত করে। তাই বিরোধ নিষ্পত্তিতে দিশা নেই।
এ-ই যখন অবস্থা, তখন পাহাড়ে আরেক উন্নয়ন দ্বারপ্রান্তে। শিগগির উদ্বোধন হতে যাচ্ছে রামগড় স্থলবন্দরের কার্যক্রম। আপাতত যাত্রী পারাপারের জন্য খুলে দেওয়া হতে পারে স্থলবন্দর। নিঃসন্দেহে এটা একটা অর্জন। খাগড়াছড়ির পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী মানুষের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরার জনগোষ্ঠীর একটা ভ্রাতৃত্ববোধ পুরোনো। এই বন্দর তাদের যোগাযোগ আরও সুগম করবে। পণ্য আমদানি-রপ্তানিতেও দারুণ প্রভাব ফেলবে নিঃসন্দেহে। সেটা মানছেনও পাহাড়ের ব্যবসায়ী নেতারা।
রামগড়ে সদ্য স্থাপিত বাংলাদেশ-ভারতের সংযোগ সেতু নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। সেতুটির বাংলাদেশ প্রান্তে বিজিবির একটি চৌকি রয়েছে। সেখানে এক সদস্য পাহারারত, যাতে কেউ সেতু অতিক্রম করতে না পারে। সাধারণ মানুষ সেতুটিতে গিয়ে ছবি তুলছে প্রতিদিনই। যত দূর চোখ যাচ্ছে, এপার থেকে ওপারে, ত্রিপুরা রাজ্যের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কাঁটাতার ডিঙানোর সামর্থ্য নেই। তাই দুই দেশের নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে মানুষ স্থির ও ভিডিওচিত্রে সাক্ষী করছে নিজেকে।
পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষও খুশি এমন উন্নয়নে। কিন্তু বারবার প্রশ্ন আসে, শান্তি ও সম্প্রীতির কী হবে? মুখে মুখে সম্প্রীতি ও শান্তির জয়গানে আর মজতে চায় না তাঁরা। এই জয়গানের সঙ্গে আপস করে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর একটা অংশ দিন দিন দুর্গম পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। জনসমাগম ও জনরোষ এড়াতে কেবল দুর্গম অরণ্যে বসত গড়ছে। কোথায়, কখন শান্তি আসবে? কখন ফিরে পাবে ভূমির অধিকার? এমন প্রশ্নে নিরুত্তর।
নতুন মাইলফলক রামগড় স্থলবন্দরের নতুন সেতু থেকে নামতেই দুটি প্যাগোডা ও গির্জা মুখোমুখি। নাগালের কাছাকাছি রামগড় বাজারের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। এগোতে থাকলাম হেঁটে, কয়েক কদম। দুপাশে মসজিদ ও দুই ভিন্নধর্মীয় উপাসনালয়ে মাঝের দারোগাপাড়া এলাকার জায়গায় পাশাপাশি দেখা গেল তিনটি সমাধিক্ষেত্র—খ্রিষ্টানদের কবরস্থান, বৌদ্ধদের শ্মশান ও মুসলিমদের কবরস্থান। জীবদ্দশায় দূরত্ব থাকলেও মৃত্যুর পর তারা আজ প্রতিবেশী।
প্রণব কৃুমার বল প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক