গল্পগুলো নতুন নয়

গল্পগুলো মোটেই নতুন নয়। জানা ও শোনা গল্পই ঘুরেফিরে শুনি; লোকমুখে, পত্রপত্রিকায়। দুরকমের গল্প পাঠক বেশ পছন্দ করে। রাজনীতির ও অপরাধের। দেশের রাজনীতি তো এখন বেশ স্তিমিত। সেখানে নির্বাচন হয়; কিন্তু ফল থাকে ‘পূর্বনির্ধারিত’। প্রার্থীরা ভোটারদের তুলনায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতিই অধিক মনোযোগ দেন। সংসদ জমে না। তার বাইরে দুই বড় পক্ষের দিক থেকে যেসব আওয়াজ শোনা যায়, সেগুলো সবই বারবার শোনা; তাই রাজনীতিতে তেমন একটা নতুন গল্প পাওয়া যায় না। তবে অপরাধের খবর বেশ পাওয়া যায়। 

অপরাধগুলোও যে খুব বৈচিত্র্যপূর্ণ, তা অবশ্য নয়। মোটামুটি একই রকমের। ব্যতিক্রমী দু–একটি ছাড়া অপরাধের পেছনে যে অপরাধ থাকে, তাদের সম্পর্কে অনুসন্ধান করবে, এমন সাধ্য নেই পত্রিকার। সাংবাদিকেরা পারেন; তাঁদের সে সক্ষমতা রয়েছে, তবে তাঁদের অনুসন্ধান করতে দেওয়া হয় না। মালিকপক্ষ থেকে শুরু করে নানা স্বার্থান্বেষী মহল বা গোষ্ঠী কেউ তা চান না। সরকারের নানা বাধা ও আইনের ভয় তো আছেই।

আরও পড়ুন

দেশে সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে সম্পদ পাচার। সম্পদ তৈরি হয় মানুষের শ্রমে, আর সম্পদ যাঁরা তৈরি করেন তাঁরা বঞ্চিত হবেন, এটাই অবশ্য নিয়ম। সে-নিয়মই চলে আসছে যুগ–যুগান্তর ধরে। সম্পদ পাচারকারীদের কার্যক্রম এবং পরিচয় দুটোই রোমহর্ষ পর্যায়ের; কিন্তু সেটা উন্মোচিত হয় না। আরেক অপরাধ খেলাপি ঋণ।

ব্যাংক নিজে টাকা তৈরি করে না, ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন দেশের মানুষ; সেই টাকা ব্যাংকের সাহায্যেই নিয়ে নেন বড় বড় ধনীরা। টাকাটা যদি তাঁরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতেন, তবু না হয় বুঝতাম কাজে লাগছে। না, ওই টাকা কাজে লাগে না; তার বড় অংশই বাইরে চলে যায় অদৃশ্য পথে। 

ওদিকে সংবাদপত্রগুলোও যে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে, তা মোটেই নয়। সংখ্যায় খবরের কাগজ এখন অনেক; কিন্তু তাদের অধিকাংশই পাঠককে আকর্ষণ করে না। প্রধান কারণ, যে গল্পগুলো তারা ছাপে, সেগুলো সবই ভাসা–ভাসা, সত্যের গভীরে যায় না। এবং খবরগুলো সবই একই ধরনের। পূর্বপরিচিত।

গল্পের ভেতরেও অবশ্য গল্প থাকে, গল্পে জড়িত মানুষের অনুভূতি অনুভব–অভিজ্ঞতা নিয়েই তো গল্প; সেসবের খোঁজ করার জন্য প্রয়োজন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির, এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিটা কোনো মানুষের একার সম্পত্তি নয়, সেটা গড়ে ওঠার জন্য পরিবেশ ও পরিস্থিতির আনুকূল্য চাই। আনুকূল্য নেই। সে জন্য গল্পের ওপরটাই দেখা যায়, আদত খবর পাওয়া যায় না। 

ওদিকে আবার পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। যেখানে আঙুল দিয়ে টিপলেই খবরের কাগজে যে খবর পরে ছাপা হবে, তা চলে আসে। তা ছাড়া সেখানে থাকে গুজব। অনেক গুজব এমন, যা সংবাদপত্রের সাধ্য নেই ছাপে। এবং লোকে মনে করে যা রটে, তা কিছু কিছু তো বটে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার নানা রকমের মন্তব্যও পাওয়া যায়। সেগুলো কেবল যে মুখরোচক তা-ই নয়, প্রায়ই ক্ষুব্ধ মনের প্রতিক্রিয়া, যে ক্ষোভ সংবাদপত্রে প্রকাশের পথ পায় না।

আরও পড়ুন

বৈচিত্র্যপূর্ণ গল্পের আকালটা নাটক এবং চলচ্চিত্রকেও আক্রমণ করেছে। স্বাধীনতার পরে ঢাকায় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল নাটকের ক্ষেত্রে নবসৃষ্টির একটা জোয়ার বয়ে যাবে। সেটা ঘটল না। বড় কারণ ভালো নাটকের অভাব। ভালো নাটক তো পরের কথা, যেনতেন প্রকারের নাটক লেখাও কমে গেল। নাট্যকারেরা কী নিয়ে লিখবেন? গল্প পান না। যেসব গল্প চারদিকে দেখেন, তাঁদের নিয়ে নাটক জমে না। 

গল্পের ভেতরেও অবশ্য গল্প থাকে, গল্পে জড়িত মানুষের অনুভূতি অনুভব–অভিজ্ঞতা নিয়েই তো গল্প; সেসবের খোঁজ করার জন্য প্রয়োজন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির, এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিটা কোনো মানুষের একার সম্পত্তি নয়, সেটা গড়ে ওঠার জন্য পরিবেশ ও পরিস্থিতির আনুকূল্য চাই। আনুকূল্য নেই। সে জন্য গল্পের ওপরটাই দেখা যায়, আদত খবর পাওয়া যায় না। 

আগের দিনে পাড়ায়–মহল্লায় নাটক হতো, এখন হয় না। অনেক জায়গায় কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে, সেখানে নাটক মঞ্চায়ন সম্ভব, যদি উদ্যোগ থাকে; কিন্তু উদ্যোগ নেই। প্রধান কারণ মানুষ এখন আগের তুলনায় অনেক অধিক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সামাজিকভাবে যে কাজ করবে, সে উৎসাহে ভাটা পড়েছে। দায়ী অবশ্য পুঁজিবাদের উৎপাত। পুঁজিবাদ মানুষকে পরস্পরবিচ্ছিন্ন করে, সমবেত হতে দেয় না। প্রত্যেকেই নিজের নিজের মুনাফা খোঁজে, ফলে তারাই শুধু সুবিধা করে নেয়, যারা অন্যদের ঠকাতে পারে। 

‘দশে মিলে করি কাজ, হারিজিতি নাহি লাজ’ মনোভাব আগের কালে তবু বইয়ে পাওয়া যেত, সমাজে যদিও কমই ছিল, কিন্তু এখন তো তা পরিপূর্ণ রূপেই অনুপস্থিত। এমনকি বইপুস্তকেও নেই। ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’—এই নীতিবাক্য এখন হাস্যকর শোনায়। কারণ, বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত।

তা নাটক দেখার একটা সুযোগ ছিল টেলিভিশনে। এখন তো চ্যানেল অনেক, তাই নাটকও অনেক। কিন্তু সেই একই সমস্যা—নাটকে গল্প নেই। নাটকের গল্পে প্রধান প্রয়োজন দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব এখন জীবনের সর্বত্র; কিন্তু সেসব দ্বন্দ্বের মূলে যে কারণ—অর্থনীতি ও রাজনীতি, তাদেরকে বিবেচনার বাইরে রেখে দেওয়া হয়; ফলে আসল গল্পটা সামনে আসে না, নাটকও জমে না। 

টাকাপয়সার কথা, প্রতারণা–ছলনা, সংঘাত-সংঘর্ষ, এসবই থাকে নাটকজুড়ে। তাদের পেছনকার কারণ হয়তো মুচকি হাসে। তা ছাড়া টেলিভিশন তো আসলে চলে বিজ্ঞাপনের জোরে। কখনো কখনো মনে হয় নাটক দেখানো বুঝিবা বিজ্ঞাপন প্রচারের অজুহাত মাত্র। চলচ্চিত্রের যে দুর্দশা এখন দেখা দিয়েছে, তারও একটা কারণ কিন্তু গল্পের দুর্বলতা। গল্পের অভাবকে ভরার চেষ্টা করা হয় ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি, গুন্ডামি, চিৎকার, কান্নাকাটি ইত্যাদির হট্টগোল দিয়ে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়