মাস দুয়েক আগের কথা। খবর পেলাম, লালমনিরহাটে তিস্তা রেলসেতুর কাছে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। কাজটা করছেন একজন প্রভাবশালী। তাঁর আপন ভাই সরকারি কর্মকর্তা। আয়ের কোনো বৈধ উৎস না থাকলেও তাঁরা বিত্তহীন থেকে কোটিপতিতে পরিণত হয়েছেন।
তাঁদের আয়ের উৎস নিয়ে নানান কথা প্রচলিত। তাঁদের অর্থ আর সরকারি চাকরির দাপটে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারেন না। রাত ১২টার পর প্রায় অর্ধশত ট্রাক্টরে তাঁরা বালু উত্তোলন করছিলেন। আমি ট্রাক্টরের ড্রাইভারের সাক্ষাৎকারমূলক ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপও পাঠাই জেলা প্রশাসক বরাবর। অনুরোধ করি বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য।
অভিযোগ করার দু-এক দিনের মধ্যে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের ধরার জন্য অভিযান চালাতে রাতে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটসহ একটি দল পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু সেদিন আর বালু উত্তোলনকারীরা ছিলেন না। অনুমান করা যায়, বালু উত্তোলনকারীরা কোনো না কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন রাতের অভিযানের কথা। তিস্তা থেকে বালু উত্তোলন করে তাঁরা পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলার চায়নাবাজারে রেখেছিলেন। সেই বালুর উৎস ধরেও বালুখেকোদের খুঁজে বের করা যেত, সেটি আর করা হয়নি।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলাতেও তিস্তা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছিল। বিষয়টি কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবর জানানোর পর বালু উত্তোলন বন্ধ হলেও দুই দিন পর রাতে বালু উত্তোলন শুরু হয়েছে। এখন রাত ১২টার পর বালু তোলার জমজমাট উৎসব চলে।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা নদীর ওপর শেখ হাসিনা সেতুর কাছেই বালু উত্তোলন হতো। গঙ্গাচড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হলে তিনি বালু উত্তোলন বন্ধ করেন। এরপর রাতে বালু উত্তোলন শুরু হয়। রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে জানানো হলে তিনি বালু উত্তোলনে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কয় দিন ধরে সেখানে আবারও রাতে বালু উত্তোলন চলছে।
বালুখেকোরা বুঝে গেছেন, অবৈধভাবে যত বালু তোলা হোক না কেন, শাস্তির ব্যবস্থা নেই। খুব বেশি হলে মেশিন ও কিছু পাইপ সরকার জব্দ করবে, এটুকুই। এটুকুর জন্য তাঁরা বালু উত্তোলন বন্ধ করেন না। এ কথা বহুল প্রচলিত, এক রাতে এক মেশিনে যত টাকার বালু উত্তোলন করা হয়, তা মেশিন ও পাইপের মূল্যের চেয়ে ঢের বেশি।
কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার কাচকোল নামক স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদে বাঁধসংলগ্ন এলাকা থেকে চলছে বালু উত্তোলন। ওই স্থান থেকে একজন মুঠোফোনে বিষয়টি জানালেন। খবর নিয়ে জানলাম, ওখানকার বালু উত্তোলন বন্ধ করা কঠিন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নাকি সেই বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত। বেপরোয়া সেখানকার বালু উত্তোলনকারীরা। বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের জানানোর পর বালু উত্তোলন আরও বেড়েছে।
রংপুরের ঘাঘট নদ থেকে দিনেই দেদার বালু উত্তোলন চলে। অতীতে আমরা বহুবার জানিয়েছিলাম জেলা প্রশাসনে। জানানোর পর বালু উত্তোলন বন্ধ হয়। কয় দিন বাদে আবারও চলে বালু উত্তোলন। অনেক স্থানের মতো এখানেও চলে চোর–পুলিশ খেলা।
লালমনিরহাটের সানিয়াজান, রংপুরের শালমারা নদী থেকে বালু উত্তোলন হতো। আমরা প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই বালু উত্তোলন বন্ধের ব্যবস্থা করেছি। ধরলা থেকে দিনের বেলায় বালু উত্তোলন করা হয়। সবার চোখের সামনে। এ বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি।
রাতে বালু তুললেও সেই বালু কোথাও না কোথাও স্তূপ করে রাখা হয়। কে বালুর স্তূপ করেছে, অনুসন্ধান করলেই বালুখেকোদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব। কাজটি করতে দেখা যায় না। অবৈজ্ঞানিকভাবে ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীর বিভিন্ন সময় বড় ধরনের ক্ষতি সাধিত হয়। অনেক সময় বালু উত্তোলন করার কারণে নদীর ভাঙন তীব্র হয়। গতিপথও কখনো কখনো বদলাচ্ছে।
বালু উত্তোলন যদি কোথাও হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, কারও না কারও পৃষ্ঠপোষকতায় এ বালু উত্তোলন হয়। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজনের সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু স্থানীয় লোকজন সরকারদলীয় বালু উত্তোলনকারীদের ভয় করেন।
যাঁরা সাধারণত বালু উত্তোলন করেন, তাঁদের সঙ্গে সরকারদলীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকে, নয়তো তাঁরা সরকারদলীয় হন। সরকারদলীয় লেবাস কষা থাকলে তো কোনো কথাই নেই। স্থানীয় প্রশাসন সরকারদলীয়দের বাইরে যেতে চান না।
কখনো কখনো প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের যুক্ত থাকার সন্দেহের কথাও শোনা যায়। এমনকি গণমাধ্যমকর্মীদের জড়িত থাকার কথাও কখনো কখনো জানা যায়।
বালুখেকোরা বুঝে গেছেন, অবৈধভাবে যত বালু তোলা হোক না কেন, শাস্তির ব্যবস্থা নেই। খুব বেশি হলে মেশিন ও কিছু পাইপ সরকার জব্দ করবে, এটুকুই। এটুকুর জন্য তাঁরা বালু উত্তোলন বন্ধ করেন না। এ কথা বহুল প্রচলিত, এক রাতে এক মেশিনে যত টাকার বালু উত্তোলন করা হয়, তা মেশিন ও পাইপের মূল্যের চেয়ে ঢের বেশি।
কার্যত দেশজুড়েই আছে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিশাল যজ্ঞ। আছে বড় বড় সিন্ডিকেট। পাড়া-মহল্লা পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত সব স্তরের ব্যক্তিদের নামই শোনা যায়। এ সিন্ডিকেটে সরকারের বেতনভোগী অসাধু ব্যক্তিরাও আছেন। তাহলে এ বালু উত্তোলন বন্ধই-বা হবে কীভাবে?
অসাধু রাজনীতিকদের আশকারায়, আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তরতর করে বেড় উঠছেন বালুখেকোরা। স্থানীয় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে। দিনে-রাতে ক্রমাগত বালু উত্তোলন হয় আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানেন না, এ কথা অবিশ্বাস্য। বালু উত্তোলন বন্ধে সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেবল মেশিন-পাইন জব্দ করে এ সর্বনাশ রোধ করা যাবে না। যে উপজেলায় বালু উত্তোলন হবে, সেই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় এটাও শোনা যায়, পুলিশেরও সংশ্লিষ্টতা থাকে বালু উত্তোলনে। ফলে কোনো পুলিশ জড়িত থাকলে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো রাজনীতিক এ সর্বনাশা কাজে জড়িত থাকলে, তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এসবের সম্ভাবনা খুবই কম। সম্ভাবনার জায়গাটি হলো—স্থানীয় লোকজনের জেগে ওঠা। স্থানীয় লোকজন জেগে উঠলেই নদী থেকে কেবল অবৈধ বালু উত্তোলন নয়, জীবন্ত সত্তা হিসেবে তাদের সব অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক