নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে শুধু আমেরিকান গণতন্ত্রের টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন জড়িত নয়। বরং এর সঙ্গে অর্থনীতির সুদূরপ্রসারী প্রভাবের বিষয় আছে, যা কিনা বাকি বিশ্বের ভবিষ্যতের ওপরও প্রভাব ফেলবে। আমেরিকান ভোটাররা এখন দুটি ভিন্ন নীতির উদ্দেশ্যগুলোর কোনটিকে বেছে নেবেন, সেই বিবেচনার মুখে পড়ে গেছেন।
যদিও ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এখনো তাঁর অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিস্তারিতভাবে খোলাসা করেননি। আন্দাজ করা যাচ্ছে, তিনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিদ্যমান কর্মসূচির মূল নীতিগুলোকে ঠিক রাখবেন। যেমন অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ধরে রাখা, পরিবেশ সংরক্ষণ (গ্রিনহাউস-গ্যাস নির্গমন হ্রাসসহ), জীবনযাত্রার খরচ কমানো, প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা বজায় রাখা, জাতীয় অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানো এবং বৈষম্য কমানো।
বিপরীতে অধিকতর ন্যায়সংগত, শক্তিশালী ও টেকসই অর্থনীতির বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো আগ্রহ নেই। এসবের বদলে তিনি কয়লা ও তেল কোম্পানিগুলোকে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা ইলন মাস্ক ও পিটার থিয়েলের মতো শতকোটিপতিদের উৎফুল্ল করেছে। ট্রাম্পের এই নীতিকে মার্কিন অর্থনীতিকে দুর্বল, কম প্রতিযোগিতামূলক এবং অধিক বৈষম্যমূলক করার একটি ‘রেসিপি’ বলা যেতে পারে। একদিকে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক কার্যক্রমের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য লাগসই নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন; অন্যদিকে ধাক্কাগুলো সামলানো এবং নতুন সুযোগগুলো আয়ত্তে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জনও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ট্রাম্প ও কমলা—কে কীভাবে এই বিষয়গুলো পরিচালনা করবেন, সে বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে মোটামুটি একটি ধারণা পেয়েছি। ট্রাম্প গদিতে থাকা অবস্থায় কোভিড-১৯ মহামারি খুব খারাপভাবে মোকাবিলা করেছিলেন এবং তাঁর ভুল পদক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। নজিরবিহীন যেকোনো পরিস্থিতি সামনে এলে তা মোকাবিলায় সর্বোত্তম বিজ্ঞাননির্ভর সিদ্ধান্ত দরকার। ট্রাম্পের মধ্যে সেই বিজ্ঞানভিত্তিক বিবেচনার অভাব সুস্পষ্ট।
অন্যদিকে কমলা হ্যারিসের মধ্যে এমন এক নেতৃত্ব দেখা যায়, যাতে তাঁকে বাণিজ্য ও অর্থনীতির সুষম সমাধানে চিন্তাশীল এবং বাস্তববাদী বলে মনে হয়। ট্রাম্পের মধ্যে আমরা এমন এক আবেগপ্রবণ ও আত্মরতিমগ্ন মানসিকতা দেখতে পাই, যাতে মনে হয়, তিনি বিশৃঙ্খলাকেই এগিয়ে যাওয়ার সোপান মনে করেন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক দক্ষতাকে খারিজ করে দেন।
চীনের হুমকি মোকাবিলায় ট্রাম্প যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, সেটির কথা ভাবুন। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি চীন থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাব দেওয়ার পর যেকোনো বুঝদার অর্থনীতিবিদের ট্রাম্পকে বোঝানো উচিত যে এটি করা হলে যুক্তরাষ্ট্রে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যাবে। এতে শুধু চীন থেকে সরাসরি আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়বে না, চীনা খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবহৃত হয়, এমন অনেক স্থানীয় পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। এতে নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের আমেরিকানদের ওপর খরচের ধাক্কা আসবে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
এর চেয়ে খারাপ খবর হলো, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতাকেও হুমকিতে ফেলার মতো চরম অবস্থান নিয়েছেন। সেদিক থেকে ভাবলে বোঝা যায়, ট্রাম্প যদি আরেক দফা ক্ষমতায় আসেন, তাহলে মার্কিন অর্থনীতি অনিশ্চয়তায় পড়বে। বিনিয়োগ হতাশাজনক জায়গায় যাবে। প্রবৃদ্ধি ধাক্কা খাবে এবং প্রায় নিশ্চিতভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
যদিও ট্রাম্পের মতো জনতুষ্টিবাদী বক্তৃতাবাজ নেতারা বিনিয়োগ ঘাটতি নিয়ে চিন্তা করেন না, তবে তাঁর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরকার এবং বাইরের বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।
কারণ অ-উৎপাদনশীল ব্যয়ের ফুলেফেঁপে ওঠা আশঙ্কাজনকভাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে, অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা কমাবে এবং বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। ট্রাম্প যদি ক্ষমতায় আসেন এবং বাইডেন প্রশাসনের স্বাক্ষরিত মূল্যস্ফীতি হ্রাস আইন বাতিল করেন, তাহলে তা কেবল পরিবেশের জন্যই খারাপ হবে না, বরং দেশের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্ববহ খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই আইন বাতিল করলে ওষুধশিল্পকে অস্থির হবে। ওষুধ উৎপাদনের খরচ কমিয়েছে এমন বিধানগুলো তখন বাদ পড়ে যাবে। এতে স্বাস্থ্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের শক্তিশালী প্রতিযোগিতা নীতিগুলোকে ট্রাম্প গুটিয়ে নিলে তা যুক্তরাষ্ট্রে আবার বৈষম্য বাড়াবে। বাকি বিশ্বে এর প্রভাব পড়বে।
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত