টানেল হলো, এবার নতুন কালুরঘাট সেতুও হোক

কালুরঘাট সেতু

অর্থনীতি ও শিল্পের বিকাশ এবং নতুন নগরায়ণের এক বিপুল সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হওয়ার মাধ্যমে। ২৮ অক্টোবর শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলটি উদ্বোধন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা এই সেতু কর্ণফুলী নদীর এক পাড়ে আনোয়ারাসহ পুরো চট্টগ্রামের চেহারা বদলে দেবে। পাশাপাশি নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার এক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যের উপস্থিতি, সর্বোপরি হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ঘিরে আনোয়ারায় এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক এই  টানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটিকে স্মরণীয় করতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে প্রশাসন।

দেয়াং পাহাড়ের পাদদেশে কোরিয়ান ইপিজেডের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষের কোলাহল ও আনন্দ উৎসবের সময় অন্য একটি জায়গা ছিল সুনসান নীরব। কিন্তু জায়গাটা সাধারণত সরব থাকে। চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থার সঙ্গে এই জায়গার নাম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। এই স্থানে সারা দিন, এমনকি মধ্যরাত পর্যন্ত মানুষের কোলাহল থাকে। সেতু পারের জন্য কর্ণফুলীর দুই তীরে অপেক্ষমাণ যানবাহনের দীর্ঘ সারি থাকে। এখানে এলেই যেকোনো সময় শত শত মানুষের উদ্বিগ্ন মুখ প্রত্যক্ষ করবেন—কার আগে কে যাবে, কে উঠবে তাড়াতাড়ি সেতুর ওপর, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা, বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার থেকে শুরু করে নানা যানবাহন নিয়ে সারা দিন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করে সেখানে। চলে এক আশ্চর্য প্রতিযোগিতা।

পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে আমি কালুরঘাট সেতুর কথাই বলছিলাম। কালুরঘাট সেতুর নিত্যনৈমিত্তিক যানজট, কোলাহল, বিশৃঙ্খলের দৃশ্য টানেল উদ্বোধনীর দিন ছিল না। বোয়ালখালীবাসীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি বিরাট এলাকার বাসিন্দাদের নীরব কান্নার মতো কালুরঘাট সেতু সেদিন নীরব ছিল। যেন কালুরঘাট সেতু সেদিন নীরবতা দিয়েই তার প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছিল। সেদিনই শুধু নয়, গত আগস্টের ১ তারিখ থেকে কালুরঘাট সেতু নীরব হয়ে আছে। ২০২১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষিত ৯৩ বছর বয়সী এই সেতুর মেরামত চলছে। কারণ, কদিন পরই এই প্রাচীন সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করবে দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের আরেকটি মাইলফলক—কক্সবাজারগামী ট্রেন।

সুদূর ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে এই পথ দিয়ে পর্যটকবাহী ট্রেন যাওয়ার জন্য সেতুটি প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ কারণে এখন যান চলাচল একেবারে বন্ধ রয়েছে। জরুরি কিছু যানবাহন ফেরি দিয়ে চলাচল করছে। নয়তো বেশির ভাগ যানবাহন মনসার টেক হয়ে অথবা পাঁচুরিয়া হয়ে শাহ আমানত সেতু দিয়ে প্রায় দ্বিগুণ বাড়তি পথ দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। নভেম্বরে এই মেরামতের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কালুরঘাটের সংস্কার শেষ হলে নতুন ঝকমকে ট্রেন যাবে। কক্সবাজারে নির্মিত নান্দনিক রেলওয়ে স্টেশনে ভ্রমণবিলাসীদের নিয়ে ট্রেন থামবে। কিন্তু দক্ষিণ চট্টগ্রামের একাংশের মানুষের থেমে থাকা জীবন যেন আর সচল হবে না। নতুন ট্রেন যাবে আর দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। কারণ, চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে কালুরঘাট সেতু দিয়ে রেল যাওয়া-আসা শুরু হলে এই পথে যাতায়াতকারী ট্রেনের সংখ্যাও অনিবার্যভাবে বাড়বে। আর কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন যখন যায়, তখন দুই পাশের যানবাহনগুলো আর চলে না। তাদের অপেক্ষা করতে হয় ট্রেন পার হওয়া পর্যন্ত। ট্রেন পার হতে হতে দুই পাশে ১ থেকে ২ কিলোমিটার পর্যন্ত যানবাহনের লাইন পড়ে যায় উভয় দিকে। ট্রেন পার হওয়ার পর এক পাশ থেকে যানবাহনগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়। অপর পাশের অপেক্ষা তখনো শেষ হয় না। একমুখী কালুরঘাট সেতু দিয়ে দুই মুখে গাড়ি চলে না। এ রকমভাবে ট্রেন যত বাড়বে, ততই মানুষের অপেক্ষা আর দুর্ভোগ বাড়বে। তাই উন্নয়নের এই বিপুল জোয়ারেও বোয়ালখালীবাসীর মুখে উদ্বেগের রেখা ফুটে ওঠে।

এ কারণেই হয়তো টানেল উদ্বোধনের আনন্দের দিনেও বোয়ালখালীবাসীর মনের কথার প্রতিধ্বনি করলেন এখানকার দুই জনপ্রতিনিধি। তাঁরা দুজন হলেন চান্দগাঁও-বোয়ালখালী আসনের সংসদ সদস্য নোমান আল মাহমুদ, অন্যজন হলেন বোয়ালখালী পৌর মেয়র জহুরুল ইসলাম। দুজনেই সেদিন কালুরঘাটে একটি স্থায়ী সেতু নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান। চট্টগ্রামবাসীর এই   আশা কখন কীভাবে পূরণ হবে, আমরা জানি না। তাঁর আগে এই এলাকার দুই সংসদ সদস্য মঈনুদ্দিন খান বাদল এবং মোসলেম উদ্দিন আহমেদও স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁরা এলাকার জনগণকেও কালুরঘাট সেতু নিয়ে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই তাঁরা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।

একটি নতুন রেল ও সড়কসেতু হবে, এ রকম স্বপ্ন দেখতে দেখতে কত মানুষ শৈশব, যৌবন পার করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গেছেন। নানা রকমের সম্ভাব্যতা যাচাই, নকশা প্রণয়ন ও অদলবদল করতে করতে একটা দশক কেটে গেছে। বছরের পর বছর যাচ্ছে। আর এর ব্যয়ও বাড়ছে। টানেল হয়ে গেছে মাত্র সাড়ে চার বছরে। কালুরঘাট সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ১০ বছরেও হয় না। টানেলের উদ্বোধনী দিনের মতো আরও একটি উন্নয়ন-ঝলমলে দিন দেখতে চান চট্টগ্রামবাসী, সেটা কালুরঘাট সেতু উদ্বোধনের দিন। সেই দিন চলতি দশকের মধ্যেই আসুক। এই আশা যেন আর হতাশায় পরিণত না হয়।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক