রাশিয়া তার জ্বালানি শক্তিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংকট তৈরি করেছে। আর প্রথম সারির শিকার হয়েছে বাল্টিক সাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো। কিন্তু বাল্টিক দেশগুলো তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করে এবং রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দিয়ে মাত্র আট বছরে তাদের বায়ু বিদ্যুৎ ক্ষমতা সাত গুণ পর্যন্ত বাড়াতে পারে। আর এর মাধ্যমে এই অঞ্চলের দেশগুলো গোটা ইউরোপকে রাশিয়ার জ্বালানি অস্ত্র থেকে রক্ষা পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই লক্ষ্যে এই সপ্তাহে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত বাল্টিক সাগরীয় জ্বালানি নিরাপত্তা শীর্ষ সম্মেলনে (বাল্টিক সি এনার্জি সিকিউরিটি সামিট) ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট, ইইউ এনার্জি কমিশনার; জার্মানি, পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেন এবং ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও জ্বালানি মন্ত্রীদের একত্রিত হয়েছিলেন। বহু শতাব্দী ধরে বাল্টিক সাগর আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র হয়ে আছে। সেই অবস্থার অবসানের দিকে আমাদের যেতেই হবে। আনন্দের বিষয় হলো, আজ আমাদের এখানকার আটটি দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য এবং এখন আমরা নিজেদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে জ্বালানি সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে পেরেছি।
এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমাদের সামনে রাশিয়ান জ্বালানির ওপর আমাদের ঐতিহাসিক নির্ভরতা দূর করার এবং ভবিষ্যতে আমাদের নিজেদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার একটি অনন্য সুযোগ এসেছে। এর মাধ্যমে আমরা বিশ্বকে দেখাতে পারি, জ্বালানি শক্তিকে কখনই নিপীড়নের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা উচিত নয় বরং তা সহযোগিতা এবং সমৃদ্ধির উৎস হিসাবে ব্যবহার করা উচিত।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ যতটা অযৌক্তিক ও অন্যায্য, ততটাই মর্মান্তিক। এই যুদ্ধ শুরু করার পরপরই রাশিয়া তার গ্যাসকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এবং গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এই সুবাদে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে ইউরোপের জ্বালানি খাতে স্বনির্ভর হওয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে এসেছে। মনে রাখতে হবে, রাশিয়া ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে বিদ্যমান চুক্তি লঙ্ঘন করে। এর মাধ্যমে রাশিয়া ইইউকে জ্বালানি সংকটের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। দেশটি ইউক্রেনকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকার জন্য আমাদের ওপর চাপ দিচ্ছে।
রাশিয়ার কৌশল কি কাজ করবে?
আমরা গত এক দশকে জ্বালানি ইস্যুতে পারস্পরিক সহযোগিতাকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় জোরদার করেছি। বাল্টিক অ্যানার্জি মার্কেট ইন্টারকানেকশন প্ল্যান (বেমিপ) ২০০৮ সাল থেকে এই ইমারতের গুরুত্বপূর্ণ ‘ইট’ হিসেবে কাজ করছে। তবে এই সপ্তাহটি আমাদের জ্বালানি সুরক্ষার জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। কারণ এই সপ্তাহে আমাদের আটটি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক জোট হয়ে ‘মারিয়েনবোর্গ ঘোষণাপত্রে’ সই করেছে। এই ঘোষণাপত্রের লক্ষ্য চারটি:
এই ঘোষণাপত্রের প্রথম লক্ষ্য হলো: আমরা রাশিয়ান জ্বালানি আমদানি থেকে বেরিয়ে আসাকে সর্বোচ্চ চেষ্টায় ত্বরান্বিত করব। তাদের জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে আমরা আমাদের জ্বালানি ব্যবস্থা দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াব, আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় করব এবং ধীরে ধীরে আমাদের গ্যাস নেটওয়ার্কগুলোকে কার্বনমুক্ত করব।
দ্বিতীয়ত, আমরা আগামী আট বছরে আমাদের সমুদ্র উপকূলীয় বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় সাত গুণ বৃদ্ধি করার জন্য একটি লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছি।
আমাদের বাল্টিক অঞ্চলের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আছে ২.৮ গিগাওয়াট। এই ক্ষমতাকে কমপক্ষে ১৯.৬ গিগাওয়াটে উন্নীত করতে পারলে আমরা দুই কোটি ৮৫ লাখ বাড়িতে বিদ্যুৎ দিতে সক্ষম হব। এটি পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেন এবং ডেনমার্কের সবগুলো পরিবারের মোট সংখ্যার সমান।
তৃতীয়ত, স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের কিছু দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি বাড়িয়ে রাশিয়ান জ্বালানির অভাব পূরণ করতে হবে। যেহেতু এলএনজি সমুদ্রপথে পরিবহন করা হয়, সেহেতু বাল্টিক সাগরের চারপাশে ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক বাণিজ্য পরিচালনায় আমাদের অবশ্যই সমন্বয় ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। এসব কার্যক্রমের মধ্যে বন্দর এবং এলএনজি টার্মিনালের মতো অবকাঠামো নির্মাণে সহযোগিতা দেওয়াকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সর্বশেষ লক্ষ্য হলো, আমরা যৌথ আন্তসীমান্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পথ খুঁজব এবং আমাদের বাসগৃহ ও ব্যবসায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী হব। বাল্টিক দেশগুলোর জাতীয় জ্বালানি নীতির প্রতি সম্মান রেখে এ অঞ্চলের বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অবকাঠামোগত সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখব।
বিশ্বব্যাপী, গত এক দশকে জ্বালানি খাত নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১০ সাল থেকে উপকূলীয় বায়ু বিদ্যুতের বৈশ্বিক গড় মূল্য ৬০ শতাংশ কমেছে এবং আজ এটি বেশির ভাগ জীবাশ্ম-জ্বালানি উৎসের তুলনায় সস্তা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। অধিকন্তু, অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধি আমাদের সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদন করতে সহায়তা করবে এবং এটি ধীরে ধীরে রাশিয়ান গ্যাসের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিদ্যুতের ভূরাজনীতি আমাদের চোখের সামনে পরিবর্তিত হচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ব্রাসেলস, ইউরোপের অন্যান্য রাজধানী এবং ওয়াশিংটন ডিসির মধ্য দিয়ে ভূ-রাজনৈতিক শকওয়েভ বা অভিঘাতের সৃষ্টি করেছে। যেহেতু জ্বালানিকে ইউরোপের বিরুদ্ধে অনেকবার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেহেতু নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও এলএনজি উভয়েরই ক্রমহ্রাসমান খরচ এবং হাইড্রোজেন অর্থনীতির আবির্ভাব আমাদের জ্বালানি সুরক্ষায় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমাদের সামনে রাশিয়ান জ্বালানির ওপর আমাদের ঐতিহাসিক নির্ভরতা দূর করার এবং ভবিষ্যতে আমাদের নিজেদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার একটি অনন্য সুযোগ এসেছে। এর মাধ্যমে আমরা বিশ্বকে দেখাতে পারি, জ্বালানি শক্তিকে কখনই নিপীড়নের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা উচিত নয় বরং তা সহযোগিতা এবং সমৃদ্ধির উৎস হিসাবে ব্যবহার করা উচিত।
(এই নিবন্ধে অনুসমর্থনসূচক স্বাক্ষর করেছেন: সুইডেনের জ্বালানি ও ডিজিটাল উন্নয়ন মন্ত্রী খাশায়ার ফরমানবার, এস্তোনিয়ার অর্থনৈতিক বিষয় ও অবকাঠামো মন্ত্রী রিনা সিক্কুত, পোল্যান্ডের জলবায়ু ও পরিবেশ মন্ত্রী আনা মস্কওয়া, লাটভিয়ার অর্থমন্ত্রী ইলজে ইন্দ্রিকসোন, ফিনল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী মিকা লিন্টিলা এবং লিথুয়ানিয়ার জ্বালানি মন্ত্রী ডাইনিয়াস ক্রিভিস)
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
রবার্ট হ্যাবেক জার্মানির অর্থনীতি ও জলবায়ু সুরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী; কাদরি সিমসন ইইউ এনার্জি কমিশনের একজন সদস্য এবং ড্যান জর্গেনসেন ডেনমার্কের জলবায়ু, জ্বালানি এবং পরিসেবা মন্ত্রী।