গত শুক্রবারের বিএনপির মহাসমাবেশে জমায়েত ভালো ছিল। সেই হিসেবে একে সফল বলা যায়। সেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার করা হয়েছে। বিএনপির অনেকেই একে ওই সমাবেশের বড় চমক বলে মনে করেছেন। অথচ তাঁর বক্তব্য প্রচারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং সে কারণে দলটিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পরের জনসমাবেশটি করতে হয়েছে ‘দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির বক্তব্য প্রচার করা যাবে না’, এমন শর্তে।
শুক্রবারের মহাসমাবেশের পর শনিবার ঢাকার চার প্রবেশমুখে অবস্থানের কর্মসূচি পালিত হয়েছে, আর সোমবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হয়েছে জনসমাবেশ। সব মিলিয়ে চার দিনে তিনটি কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। প্রথমটি মহাসমাবেশ, দ্বিতীয়টি অবস্থান কর্মসূচি, তৃতীয়টি জনসমাবেশ। কর্মসূচির ধারাবাহিকতা এবং প্রথমটি ছাড়া বাকি দুটি কর্মসূচির উদ্দেশ্য ও সফলতা নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন জেগেছে।
বিএনপির শুক্রবারের মহাসমাবেশে ঢাকার বাইরে থেকে কর্মী-সমর্থকেরা এসেছেন। তাঁদের এই ঢাকায় আসা সহজ ছিল না। পথে পুলিশের নানা ধরনের হয়রানিসহ অনেক বাধাবিপত্তি এড়িয়েই তাঁদের আসতে হয়েছে। শনিবার ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুক্রবারের মহাসমাবেশটি শেষ হওয়ায় কর্মীদের অনেকেই যে হতাশ হয়েছেন, তা টের পাওয়া গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে কর্মী-সমর্থকদের আক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছে।
শনিবারের অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির জমায়েত খুব ভালো হয়নি। পুলিশের হামলাসহ কিছু সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে। বাসে আগুন লাগানো হয়েছে। আগুন লাগানোর কাজটি কাদের দ্বারা হয়েছে, তা নিয়ে অবশ্য নানা গুঞ্জন রয়েছে। ধোলাইখালে বিএনপির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে মারধর করে পুলিশ তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। পরে সবাই জেনেছে যে তাঁকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছিল। দলের আরেক নেতা আমানউল্লাহ আমানের সঙ্গে বচসার এক পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে পুলিশ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এসব ঘটনা ছাপিয়ে আলোচনায় জায়গা করে নেয় গয়েশ্বরের সঙ্গে ডিবিপ্রধানের মধ্যাহ্নভোজের ছবি ও আমানের কাছে পাঠানো প্রধানমন্ত্রীর ফলের শুভেচ্ছা।
এরই মধ্যে সোমবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ সারা দেশে জনসভার কর্মসূচি পালন করে দলটি। ‘পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী হামলা, গুলি, মারধর ও গণহারে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে’ এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এটিও ছিল একটি গতানুগতিক কর্মসূচি। ঢাকার জনসভায় বিএনপির মহাসচিব শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালনের কথা বলেছেন। সম্ভবত কর্মী-সমর্থকদের হতাশ অংশের উদ্দেশেই বলেছেন, ‘এভাবেই আমরা এগিয়ে যাব। আমরা বহুদূর এগিয়ে গেছি। আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত।’
এই তিন দিনের কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির কর্মীদের শুরুতে উচ্ছ্বাস ও পরে কিছু কর্মী-সমর্থকের হতাশার মনোভাব বিবেচনায় নিলে কিছু প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। দলটির কর্মী-সমর্থকেরা আসলে কী আশা করেছিলেন? ২৮ জুলাইয়ের মহাসমাবেশকেই তাঁরা সর্বাত্মক আন্দোলন শুরুর চূড়ান্ত কর্মসূচি মনে করেছিলেন? নাকি তাঁদের সে ধরনের কিছু আভাস দিয়েই ঢাকায় আনা হয়েছিল? তা না হলে তাঁদের হতাশ হওয়ার কারণ কী? যাঁরা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছিলেন, তাঁরা সবাই শনিবার ঢাকা ছেড়ে গেছেন, তা নিশ্চয়ই নয়। সে ক্ষেত্রে শনিবারের কর্মসূচিতে জমায়েত এত কম হলো কেন? হতাশা থেকে কর্মীরা অংশগ্রহণ করেননি? নাকি শক্তি ক্ষয় না করার কৌশল হিসেবেই সেদিন দলটি বড় জমায়েতের উদ্যোগ নেয়নি?
বিএনপির মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে যে একধরনের অনিশ্চয়তা ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, তা দলের নেতা-কর্মীরা টের পান না, এমন নয়। তা ছাড়া ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে। এর মধ্যে একটা দীর্ঘ সময় তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। অত্যাচার-নির্যাতন ও জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। দলের প্রধান খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হিসেবে কারাভোগ করছেন। সরকার সেই শাস্তি স্থগিত করায় তিনি বর্তমানে বাসায় থাকতে পারছেন।
বিএনপি সরকারে পদত্যাগের এক দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে তাদের নিশ্চয়ই কোনো না কোনো পরিকল্পনা বা কৌশল বিবেচনায় আছে। তবে এটা অপরিবর্তনীয় কিছু হওয়ার কথা নয়। সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় কৌশল বা পরিকল্পনার অদলবদল হওয়াই স্বাভাবিক। আবার যে কৌশল বা পরিকল্পনাই তারা নিক, তাদের লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত অর্জিত হবে—এমন ভাবারও কোনো সুযোগ নেই। প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ তো আর বসে নেই। নিজেদের পাল্টা কৌশল ও পরিকল্পনা নিয়ে তারাও প্রস্তুত আছে।
আন্দাজ বা অনুমান করা ছাড়া আওয়ামী লীগ বা বিএনপি—কারোরই অপর পক্ষের কৌশল বা পরিকল্পনা জানার কথা নয়। দুই দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদেরও তা জানার কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিক কৌশল ও পরিকল্পনা একটি গোপন বিষয়। এখানে আওয়ামী লীগের সুবিধা হচ্ছে দলটির অধিকাংশ নেতা-কর্মী ও সমর্থক মনে করেন, তাঁদের দলের প্রধান শেখ হাসিনার কাছে যেকোনো পরিস্থিতি উতরানোর চাবিকাঠি আছে। তাঁদের আস্থা আছে, যেভাবেই হোক শেখ হাসিনা পরিস্থিতি সামাল দেবেন। কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই তা নয়।
বিএনপির মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে যে একধরনের অনিশ্চয়তা ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, তা দলের নেতা-কর্মীরা টের পান না, এমন নয়। তা ছাড়া ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে। এর মধ্যে একটা দীর্ঘ সময় তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। অত্যাচার-নির্যাতন ও জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। দলের প্রধান খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হিসেবে কারাভোগ করছেন। সরকার সেই শাস্তি স্থগিত করায় তিনি বর্তমানে বাসায় থাকতে পারছেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছ থেকে আমরা শুনেছি, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির দুটি শর্ত অনুযায়ী, রাজনীতি করতে বাধা নেই। তবে যেহেতু তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত, সেহেতু তিনি সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন করতে পারবেন না।’ কিন্তু তারপরও খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অবস্থা ও অসুস্থতাই এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দণ্ডপ্রাপ্ত। এখন বিদেশে বসে তিনি দল চালান, নির্দেশনা দেন।
বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু হয় গত বছরের অক্টোবর মাসে। বিভাগীয় শহরগুলোতে তারা ধারাবাহিকভাবে জনসভার আয়োজন করতে শুরু করে। ডিসেম্বরে ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে তা একটি পরিণতি পাবে, তেমন আশা বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী ও সমর্থকের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে দলটি তার শক্তি-সামর্থ্য ও জনসমর্থনের বিষয়টি প্রমাণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো ফল তারা পায়নি। বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আশাবাদ ধরে রাখার বিষয়টি তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশ কঠিন।
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও শিথিল হবে—এমনটা প্রত্যাশিত ছিল। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষিত হওয়ায় রাজনৈতিক পরিসরটি আগের চেয়ে আরও বিস্তৃত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি নতুন করে মাঠে নেমেছে এবং তাদের এক দফা দাবিকে একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
আগেই বলেছি, নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কৌশল বা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। সেই পরিকল্পনায় এগোনো বা পেছানোর কৌশল থাকতে পারে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিষয়টি এখন প্রতিটি কর্মসূচি ধরে হিসাব-নিকাশের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। যেমন গত চার দিনে যে তিনটি কর্মসূচি নেওয়া হলো, এর মধ্যে কোনটিতে বিএনপি জিতল আর কোনগুলোতে হারল—এভাবেই যেন দেখতে চাইছেন বিএনপির কর্মী ও সমর্থকদের অনেকে।
কিন্তু সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করানোর যে লক্ষ্য নিয়ে বিএনপি এক দফার আন্দোলনে নেমেছে, তাকে এভাবে দেখার সুযোগ আছে কি? যাঁরা আশা করেছিলেন ২৮ তারিখের মহাসমাবেশ থেকেই ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ ধরনের আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে, তাঁরা নিঃসন্দেহে বেশি আশা করে ফেলেছিলেন। একই সঙ্গে সরকারের শক্তি ও কৌশলকেও তাঁরা খাটো করে দেখেছেন।
বিএনপির বর্তমান আন্দোলনকে প্রতিটি কর্মসূচির ভিত্তিতে দেখতে গেলে কেউ এর মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সমন্বয়হীনতা দেখতে পারেন। দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হতাশা দেখাও হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও তো দেখা যাচ্ছে যে বিএনপি কী কর্মসূচি দেয়, তার ওপর ভিত্তি করে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। তার মানে বিএনপির এসব কর্মসূচিও আওয়ামী লীগকে ব্যতিব্যস্ত করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে আন্দোলন নিয়ে বিএনপির এই এগোনো-পেছানো কি আসলেই আন্দোলন নিয়ে দলটির বিভ্রান্তির প্রকাশ, নাকি এটাও একটা কৌশল? এটা আমাদের পক্ষে জানা কঠিন; কারণ, কৌশল সব সময়ই একটি গোপন বিষয়।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক। ইমেইল: [email protected]