বাংলাদেশের চিংড়িশিল্প, যার আহ্লাদী নাম ‘সাদা সোনা’। এই মহামূল্যবান সাদা সোনা কত কিছুর মূল্য দিয়ে কেনা জানেন? ডলার আয় করে বলে কত কিছু উপেক্ষা করতে হয়েছে চিংড়িশিল্পের জন্য, খোঁজ নিয়েছেন কি কেউ? ফসলি জমিতে লবণাক্ততা, ক্ষয়িষ্ণু জীববৈচিত্র্য, সুন্দরবন ধ্বংস, প্রান্তিক কৃষকের বাস্তুচ্যুত হওয়া, হ্রাসকৃত ফসল উৎপাদনের মতো বড় মূল্যের বিনিময়ে লোনাপানির চিংড়ির দ্রুত সম্প্রসারণ হয়েছিল উপকূলে। ডলারের গন্ধে উপকূলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুনাফালোভী প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। সাদা সোনার হাতছানিতে গরিব ধানচাষির সাধের জমিটা রাতারাতি চলে গিয়েছিল লোনাপানির বাগদা চিংড়ি চাষের আওতায়। লবণে বিষাক্ত ধানি জমি চিংড়ি দস্যুকে দিয়ে দেশান্তরিত হয়েছিলেন ভূমিহীন মনু মিয়া আর প্রান্তিক চাষি পবন দাস।
অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণের অশুভ পরিণাম নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, গণমাধ্যম প্রচার করেছে নানা রঙের দুঃখ-সুখের খবর। দরিদ্র কৃষকের কলিজার টুকরা তিন ফসলি জমিতে লোনাপানির আগ্রাসন নিয়ে পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ কোনোভাবেই যথেষ্ট ছিল না। শেষ পর্যন্ত ডলার উপার্জন করা সাদা সোনাশিল্প প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় বিপন্ন কৃষি ও বিপর্যস্ত জীবিকায়নের মূল্যের বিনিময়ে। গড়ে ওঠে হ্যাচারি, প্রসেসিং প্ল্যান্ট, রপ্তানি কেন্দ্র। অগত্যা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় বিশাল জনগোষ্ঠীর। নীতিকৌশলে পরিবেশ রক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ নানা কথা লেখা থাকলেও, বাস্তবে দ্রুত মুনাফা অর্জন আর কাঁচা ডলারই প্রাধান্য পায়।
কিন্তু হঠাৎ ভাবিয়ে তুলেছে চিংড়িশিল্পের ক্রমহ্রাসমান উৎপাদনশীলতা আর অনিশ্চিত গন্তব্য। গত তিন দশকে মোট উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও ফলন বাড়েনি উল্লেখ করার মতো। ১৯৯০ সালের ৯৫ হাজার হেক্টর জমির চিংড়ি চাষ ২০১৫ সাল পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর। কিন্তু দৃশ্যপটের দ্রুত পরিবর্তন হয় ২০১৫ সালের পর থেকে। আবাদ এবং রপ্তানি, দুটিই কমতে থাকে। ২০৩০ সালে ৮৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বৈশ্বিক চিংড়ির বাজারের সম্ভাবনা সামনে রেখে যেখানে প্রধান চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশে ফলন বাড়িয়েছে কয়েক গুণ, সেখানে বাংলাদেশের চিংড়িশিল্প লড়াই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে হেক্টরপ্রতি ৩৪৭ কেজি ফলন নিয়ে।
আসুন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ চিংড়ি চাষ করা জমি ও উৎপাদনের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। ২০১২ সালে চিংড়ি চাষের আওতায় জমির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর, ২০২২ সালে এটা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টরে। গত ১০ বছরে উৎপাদন কমেছে ৩৫ শতাংশ। কাঁচামালের অভাবে দেশের ১০৫টি হিমায়িত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মধ্যে বর্তমানে ৩৫টি কোনোরকমে চালু আছে। প্রধান চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের গড় ফলনই সবচেয়ে কম। ভারতের হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৪ দশমিক ২৬ টন, চীনের ৪ দশমিক ৮৭ টন, থাইল্যান্ডের ১১ দশমিক ৩৪ টন ও ফিলিপাইনের ৪ দশমিক ৫৮ টন। উৎপাদনের এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে পেছনের সারির চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশ মেক্সিকো, ব্রাজিল, ফিলিপাইন, ইরান, মালয়েশিয়া, ভেনেজুয়েলা চলে আসবে সামনের কাতারে। বাজার হারাবে বাংলাদেশের সাদা সোনা।
গত ৩০ বছরে চিংড়িশিল্পের ওপর সবচেয়ে বড় ঝড়টা ভাইরাসের আক্রমণ। মাল্টি বিলিয়ন ডলারের সম্ভাবনাময় এই শিল্প মারাত্মক উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়ে এই ভাইরাসের কারণে। অবশ্য এই ঝড় সামলাতে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইকুয়েডরসহ প্রধান চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশগুলো বিকল্প বাণিজ্যিক প্রজাতি দিয়ে বিদ্যমান ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি প্রতিস্থাপনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায়। তারা সম্ভাবনা দেখতে পায় ভেনামি প্রজাতির চিংড়িতে। ২০০০ সালের পর থেকে এসব দেশ স্বল্প পরিসরে ট্রায়াল ও ঝুঁকি বিশ্লেষণের কাজ চালাতে থাকে। বাণিজ্যিক উৎপাদনে চলে যায় ২০১০ সাল নাগাদ। ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ চিংড়িশিল্পে নিয়ে আসে নতুন বিপ্লব। বর্তমানে বৈশ্বিক উৎপাদনের ভেনামি চিংড়ির অবদান ৮০ শতাংশের বেশি। আসুন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সফলতার দিকে একবার তাকাই। ২০০০ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের চিংড়িশিল্প কাছাকাছি ছিল। ২০১৯ সালে ভারত চিংড়ি রপ্তানি করে আয় করে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা কিনা মোট বৈশ্বিক আয়ের ২৪ শতাংশ। ভারত এই বিপ্লব রচনা করেছে মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর চিংড়ির খামার থেকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর চিংড়ির খামার থেকে আয় করেছে শূন্য দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই খাতে আয় ছিল শূন্য দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
গত ১০ বছরে ভারত যেখান ভেনামি চিংড়ি চাষ করে তাদের চিংড়িশিল্পকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়, তখন বাংলাদেশের অনেক গবেষক, বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ নতুন প্রজাতির সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে শুধু চায়ের কাপে ঝড় তুলেছেন। বেসরকারি খাত ১০ বছর ধরে অনুরোধ-মিনতি করে গেছে ভেনামি চিংড়ি চাষ শুরুর অনুমতি চেয়ে। যেখানে চিংড়ি চাষের শুরুই হয়েছে কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় দিয়ে সেখানে একটা নতুন সম্ভাবনাময় প্রজাতির প্রচলন নিয়ে দ্বিধান্বিত নীতি খুবই অবাক হওয়ার বিষয়।
শেষ পর্যন্ত যখন ২০২১ সালে এসে একটু ঘুম ভেঙেছে, ততক্ষণে বাংলাদেশের চিংড়িশিল্প প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ছিটকে পড়েছে বহুদূর। এতক্ষণ ভারতের চোখধাঁধানো সফলতার গল্প শুনছিলাম। আসুন, আরও কয়েকটি দেশের চিত্র দেখি। ২০২০ সালে চিংড়ি রপ্তানি করে ভিয়েতনাম আয় করেছে ১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ইকুয়েডর ২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ইন্দোনেশিয়া ১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ট্যারিফ সুবিধা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র, ইইউতে বাংলাদেশ তার রপ্তানি বাজার হারাচ্ছে। ২০১৪-১৫ সালের তুলনায় ২০২০-২১ সালে রপ্তানি আয় ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে চিংড়ি রপ্তানি করেছে ২৭ হাজার ৯৬৭ টন, যেটা ২০১০-১১ সালে ছিল ৫৪ দশমিক ৮৯১ টন।
নতুন প্রজাতির চিংড়ি চাষ নিয়ে গবেষক, নীতিনির্ধারক ও পরিবেশবাদীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা রীতিমতো শঙ্কিত হওয়ার মতো। বিদেশি জাতের মাছ, পাখি, গরু, সবজি, ফুল-ফল কত কিনা আমাদের দেশে চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেনামি প্রজাতির চিংড়ি চাষ করলে নাকি চিংড়ি খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের মতো ইকোসিস্টেমে সফলভাবে যেখানে ভেনামি চিংড়ি চাষ হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের অতিসতর্কতা হাস্যকর বটে।
ভেনামি প্রজাতির চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ করার ফলে বৈশ্বিক চিংড়ি উৎপাদনের পরিমাণ ২০০৩ সালের ২ বিলিয়ন টন থেকে ২০১৯ সালে ৮ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু অবাক করার বিষয়, প্রধান চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে বাণিজ্যিক ভেনামি চিংড়ি চাষ এখনো শুরু হয়নি।
সাম্প্রতিক কালে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের আকাশচুম্বী উত্থানের পেছনে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ যুগান্তকরী অবদান রেখেছে। কয়েক বছর ট্রায়াল ও ঝুঁকি বিশ্লেষণের পর ভারত ২০০৯ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। এশিয়ার ১৫টি চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে ১৪টি দেশে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। আমাদের কেবল ঘুম ভেঙেছে। ২০২১ সালে ১৩টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষামূলক ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে মৎস্য বিভাগ। গণমাধ্যমে এসব ট্রায়ালের সফলতার খবরও প্রচারিত হয়েছে। এক দশক আগে যদি আমরা ট্রায়াল শুরু করতে পারতাম, তাহলে আজকের চিংড়িশিল্প অনেক সমৃদ্ধ হতো।
জোয়ার-ভাটার লোনাপানি আছে বলেই উৎপাদন বাড়ানোর জন্য অনুভূমিক সম্প্রসারণ মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। ভারতের উপকূলীয় অঞ্চল বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও দেশটি খুব হিসাব-নিকাশ করে মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমি চিংড়ি চাষে জন্য ছেড়েছে। একসময় মতলববাজ জ্ঞানীজনেরা উপকূলের লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনায় চিংড়ি চাষের জন্য ঢাকঢোল পিটিয়েছিলেন। এই ঢাকঢোলে কাজও হয়েছিল। এখন উপকূলের কৃষির দিন বদলেছে। লোনাপানি আর লোনামাটিতেই কৃষক সোনা ফলানোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। উপকূলের মাঠ তরমুজ, শর্ষে, সূর্যমুখী, সবজি, ফল দিয়ে ভরে উঠছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসলের জাত আবিষ্কার করেছে। এখন চিংড়িঘেরের জমিটাতে পুনরায় ফসল চাষ করতে চান প্রান্তিক কৃষক। চিংড়ি চাষ আর অনুভূমিক সম্প্রসারণ না করে ফলন বৃদ্ধির জন্য নীতিকৌশল ও প্রযুক্তি প্রয়োগের সময় এসেছে। ফসলি জমি রক্ষায় ভূমি ব্যবহার আইন বাস্তবায়ন ও সুচিন্তিত ক্রপ জোনিং যৌক্তিকতা শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এসডিজির জমানায় উন্নয়ন টেকসই হওয়াটায় বড় চ্যালেঞ্জ। অবিবেচকের মতো দ্রুত উন্নয়নের পেছনে ছুটলে একটি উন্নয়নের অনল সভ্যতাকে পুড়িয়ে মারবে। কৃষি, পরিবেশ ও প্রতিবেশের অনেক মূল্য দিয়ে কেনা চিংড়িশিল্প যদি না টিকে, যদি কাঙ্ক্ষিত ডলার না আনতে পারে, তাহলে কালীগঞ্জের ধানচাষির কাছে আমাদের জবাব কী?
শুধু মুনাফা দেখলে তো চলে না, উন্নয়ন-সমৃদ্ধির জন্য কত কী দেখতে হয় বাঁচতে হলে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় কার্বন নিঃসরণ, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, ইকোসিস্টেমসহ আর্থসামাজিক নানা বিষয় বিবেচনা না করলে সেই উন্নয়ন ফ্রাংকস্টাইনের দানব হয়ে আপনাকেই গিলে খাবে। বাংলাদেশের সামান্য কৃষিজমি ১৮ কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সময় এসেছে নীতিকৌশল প্রণয়নে অত্যন্ত সতর্ক হওয়ার। শুধু ডলার আর মুনাফা নয়, আমাদের নীতিকৌশলের লক্ষ্য হোক পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব ও টেকসই উন্নয়ন।
মো. রওশন জামাল প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী ও গবেষক। ই-মেইল ঠিকানা: [email protected]