একসময় খেজুরের রস ও গুড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল যশোর, এখন ফুলের জন্য। কেবল গদখালী ফুলের বাজারে প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি ফুল বিক্রি হয়। গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকাসহ বাহারি সব ফুল। যশোরের ফুলে ঢাকা সুবাসিত।
রাজধানী ঢাকা বা এর আশপাশের জনপদ এখন ঘটন-অঘটনে উত্তাল। সেই তুলনায় যশোর নিস্তরঙ্গ। গত ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের ঢেউ আছড়ে পড়ে পশ্চিম সীমান্তবর্তী এই শহরেও। ওই দিন বিকেলে ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল বের করেন। মিছিলটি সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন জাবির ইন্টারন্যাশনালের কাছে পৌঁছালে সেখান থেকে কিছু লোক গিয়ে হোটেলে হামলা চালান। প্রথম দলটি যখন হোটেলের ভেতরে ঢুকে লুটপাট করছিল, তখনই আরেক দল নিচে আগুন দেয়। এ সময় ওপরে থাকা মানুষগুলো আগুনে পুড়ে মারা যান। ফায়ার সার্ভিস ২৪টি পুড়ে যাওয়া লাশ উদ্ধার করে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া যশোর সিটি কলেজের ছাত্র মারুফ হোসেন বলেছেন, তাঁর কয়েকজন বন্ধুও আগুনে পুড়ে মারা গেছেন, যাঁরা হোটেলের ওপরতলায় গিয়েছিলেন হোটেলটি দেখতে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে শাহীন চাকলাদার এলাকাবাসীর ওপর অনেক অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছেন। মানুষ তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। এ কারণেই তাঁর হোটেলে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের বাড়ি-অফিস নিরাপদই আছে।
সম্প্রতি প্রথম আলো-শিখো আয়োজিত জিপিএ-৫ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে যশোরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয়। জানতে চাই, ছাত্র–জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর যশোরে কী পরিবর্তন এল? তাঁরা বলেন, পরিবর্তনের মধ্যে এটুকু হয়েছে, আগে যাঁরা দখলবাজি-চাঁদাবাজি করতেন, তাঁরা দৃশ্যের আড়ালে চলে গেছেন, নতুন একদল মানুষ সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে।
আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়কদের সম্পর্কে জানতে চাইলে এক সাংবাদিক সহকর্মী বলেন, তাঁদের একাংশ আছে বিএনপির সঙ্গে, আরেক অংশ জামায়াতের সঙ্গে। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কেরা এলে একসঙ্গে বসেন। অন্যথায় আলাদা কর্মসূচি পালন করেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেনাপোলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রভাতি সংঘের কার্যালয় দখল করে নিয়েছিলেন ছাত্রদল ও যুবদলের নেতা-কর্মীরা। প্রথম আলোয় সেই খবর ছাপা হওয়ার পর সেটি দখলমুক্ত করা হয়। এ ব্যাপারে বিএনপির নেতা অনিন্দ্য ইসলামের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। দলের যেসব নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি দখলবাজির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের বহিষ্কার করেছেন তিনি।
হোয়াংহো নদী যেমন চীনের দুঃখ ছিল, তেমনি ভবদহের জলাবদ্ধতা এলাকাবাসীর স্থায়ী যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। বছরের বেশির ভাগ সময় ১০ লাখের মতো মানুষ পানিবন্দী জীবন যাপন করেন। অনেকে জীবিকা হারিয়েছেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। জলাবদ্ধতা নিরসনের উপায় কী? সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির (জাহিদ) বললেন, টিআরএম বা টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (জোয়ারাধার) বা খাল কেটে জমা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকল্প নেওয়া হলেও সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য ও সাবেক সচিব কবির আনোয়ার সেটি করতে দেননি। তাঁরা হামলার নাটক সাজিয়ে টিআরএম বন্ধ করে দেন।
কেননা, টিআরএম চালু থাকলে তাঁরা যে নদী খনন প্রকল্পের নামে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন, সেটি বন্ধ হয়ে যাবে।
যশোর ইনস্টিটিউটে আলাপকালে ইকবাল কবির আরও বলেন, সরকার আসে, সরকার যায়, কিন্তু ভবদহবাসীর দুঃখের অবসান হয় না। ভবদহ অঞ্চলের নদী, পানি ব্যবস্থাপনা, প্রাণপ্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে তাঁরা গত ৮ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। কমিটির তিন দফা দাবির মধ্যে আছে, অবিলম্বে টিআরএম–টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (জোয়ারাধার) চালু করা, আমডাঙ্গা খাল দ্রুত সংস্কার এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের বিচার।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই জনপদের মানুষ দীর্ঘ ৪৪ বছর স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার। ভবদহ স্লুইসগেট, পোল্ডার এখন মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘পানি সরাও, মানুষ বাঁচাও’ স্লোগানে যশোরের জলাবদ্ধ ভবদহ অঞ্চলের দুই হাজারের বেশি নারী-পুরুষ জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ৬ অক্টোবর। কর্মসূচিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে ভবদহ অঞ্চল পরিদর্শন করে সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
যশোরবাসীর আরেকটি উদ্বেগের কারণ পলাতক আসামিদের দেশে ফিরে আসা। আলোচিত সন্ত্রাসী আনিসুর রহমান লিটন দুই দশক পর দেশে ফিরে এসেছেন। অবশ্য ৪ সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ফারজানা ইয়াসমিনের আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বিচারক তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ১৯৯৯ সালে অস্ত্র আইনের একটি মামলায় লিটনের ১০ বছরের সাজা হয়। বিদেশে থেকেও লিটন যশোরের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয়। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ফাতেমা আনোয়ার সদর উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক। গত উপজেলা নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন।
আলাপকালে সচেতন নাগরিক কমিটির যশোর শাখার সভাপতি শাহিন ইকবাল বলেন, যানজটই যশোরের প্রধান সমস্যা। আইনশৃঙ্খলা নিয়েও জনমনে শঙ্কা আছে। কোথাও কোথাও নীরব চাঁদাবাজি চলছে। অথচ পুলিশের সক্রিয়তা চোখে পড়ছে না।
১৯৯৯ সালে সংঘটিত উদীচী হত্যার বিচার সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহিন বলেন, গত আড়াই দশকে রাজনৈতিক কারণে তিনটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের একটিরও বিচার হয়নি। উদীচী, সাংবাদিক শামসুর রহমান ওরফে কেবল ও সাইফুল আলম রানা হত্যা। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, তারা মামলাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে গেছে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি