প্রথমে শুরু করি আরাধনা চাকমার অনুযোগ নিয়ে। সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। কিন্তু সে যখন তার বাংলা পাঠ্যবইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ‘বীরের রক্তে স্বাধীন এ দেশ’ অধ্যায় পড়তে যায়, তখন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ সম্পর্কে পড়তে গিয়ে দেখে, বইয়ের ২৭ নম্বর পৃষ্ঠার ১৩ নম্বর লাইনে লেখা আছে, ‘...তাঁরা মহালছড়ির কাছে বুড়িঘাট এলাকার চিংড়ি খালের দুই পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন।’
এখানে বলে রাখা ভালো, পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘চিংড়ি’ খাল নামে কোনো খাল নেই। এটি হবে, ‘চেংগী’ বা চেঙ্গী নদী। রাঙামাটি জেলার বুড়িঘাটে চেঙ্গী নদীর পারে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি রয়েছে, শত শত পর্যটক প্রতিদিন সেটি দেখতে আসেন। এখন সমস্যাটা হলো উত্তরপত্রে যখন আরাধনারা সঠিক উত্তর অর্থাৎ ‘চেঙ্গী’ খাল লেখে, তখন তাদের ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কেটে নেওয়া হয়! এভাবে ভুল তথ্যে ভরা পাঠ্যপুস্তক নিয়ে কোমলমতি শিশুরা কী শিখছে, সেটা আসলেই নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা ‘ভাষা’ রক্ষার তাগিদ অনুভব করি। অনেক সময় অতি আবেগতাড়িত হয়ে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরাও বাংলা ভাষাকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু বাংলা ভাষা পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। কাজেই বাংলা ভাষা বিপন্ন হওয়ার আদৌ কোনো আশঙ্কা নেই।
১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর তৎকালীন সরকার একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের উপস্থিতিতে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট থাকলেও বাংলা ভাষার আধিপত্যে ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু স্থানের পুরোনো নাম হারিয়ে গেছে। বর্তমানে সেসব নাম বাংলা ভাষা অনুযায়ী পরিবর্তন করে বিকৃতভাবে লেখা হচ্ছে। অথচ এসব স্থানের আদি নামকরণের পেছনে কোনো না কোনো কারণ বা ঘটনা জড়িয়ে আছে। আর এই নাম বিকৃতকরণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু জায়গার নামের সঙ্গে সঙ্গে অতীত ইতিহাসও মুছে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন অধিবাসী হিসেবে আমি এখানে এর কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি।
আমি ‘হাগারাছড়ি’র ভূমিজ সন্তান হলেও আজ আমাকেই লিখতে ও বলতে হয় ‘খাগড়াছড়ি’! চাকমা ভাষার ‘হাগারা’ এর অর্থ হলো ‘নলখাগড়া’। এ অঞ্চল একসময় নলখাগড়ায় ভরপুর ছিল বলে এর নামকরণ হয় হাগারাছড়ি। কিন্তু আদি নাম তুলে দিয়ে এখন ‘খাগড়াছড়ি’ নামেই পরিচিত।
একইভাবে মাজনপাড়া> মহাজন পাড়া, নান্যাচর> নানিয়াচর, পাগুজ্জেছড়ি> পাকিজাছড়ি, বেতবন্যা> বেতবুনিয়া, ক্যক্রডং> কেওক্রাডং, টাইংছেই> থানচি, ঙাফাখোং> নাফাখুম, রাখইংওয়া> রোয়াংছড়ি, চ্যংবত হুম> চিম্বুক, চিংম্রং> চিৎমরম, সারবোতলী> সারোয়াতলী, হুদুকছড়ি> কুতুকছড়ি ইত্যাদি জায়গার নাম বিকৃত হয়ে যায়। অন্যদিকে কিছু কিছু জায়গার পুরো নামই পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। যেমন পানছড়ি উপজেলার চাইতঙ চৌধুরী আদাম>পোড়াবাড়ি, চেমবা মাজনপাড়া> হাসান নগর, আচায় মাজনপাড়া> কলাবাগান, রবিসিং হার্বারিপাড়া> আইয়ুব আলী মেম্বারপাড়া, রসিক নাগর আদাম> রশিদ নগর, মানেক হেডম্যানপাড়া> জামতলি, বইরোপাহ্> বাঙালিপাড়া, জয়সেনপাড়া> জসিম পাড়া ইত্যাদি।
সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে আমরা ভাষা সম্পর্কে দেখি, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এ দেশে বাংলা ছাড়া আরও যেসব ভাষা আছে, সেসব ভাষার স্বীকৃতি বা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা সংবিধানে উল্লেখ নেই।
এ দেশ বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির দেশ। এ দেশে বাঙালি ছাড়া আরও ৫০টির অধিক জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে, যারা স্মরণাতীতকাল থেকেই বসবাস করে আসছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ৫০টি জাতিগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংহতি, সম্প্রীতি, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা বজায় রাখতে হলে এ দেশের অপর জাতিগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণে রাষ্ট্রকে আরও আন্তরিক ও উদ্যোগী হতে হবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গঠনের পর দেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার অবস্থান ও ভাষা পরিস্থিতি নিয়ে তথ্য অনুসন্ধানের জন্য একটি বড় ধরনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। ‘বাংলাদেশের নৃ-ভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’ শীর্ষক এ কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশে মাঠপর্যায়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। সমীক্ষাটির প্রতিবেদন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আলোর মুখ দেখেনি। সমীক্ষার প্রতিবেদনটি বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে ২০ খণ্ডে প্রকাশ করার কথা থাকলেও মাত্র ১টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়। সমীক্ষাটি পরিচালনা করতে গিয়ে বাংলা ছাড়া এ দেশে আরও ৪০টি ভাষার সন্ধান পেয়েছে ইনস্টিটিউট। এ সমীক্ষার মাধ্যমে সবচেয়ে ভয়াবহ যে তথ্যটি উঠে এসেছে, তা হলো এই ৪০ ভাষার ১৪টিই বিপন্নপ্রায়। অনেকের মতে, এই বিপন্ন ভাষাগুলোর সংখ্যা আরও অধিক হবে।
মাতৃভাষা রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এক যুগ আগে যাত্রা শুরু করলেও এই বিপন্নপ্রায় ভাষাগুলো রক্ষার জন্য কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেটা জানা খুবই জরুরি। একই সঙ্গে এ দেশের বিপন্ন ভাষা ও যেসব ভাষার বর্ণমালা নেই, সেসব ভাষা সংরক্ষণ ও বাংলা ভাষার আধিপত্য থেকে রক্ষার জন্য সেই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। মোটকথা হলো, এ দেশে বাংলা ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার, সুরক্ষা, বিকাশ ও প্রসারের লক্ষ্যে ইনস্টিটিউটটিকে ডিজিটাল ডকুমেন্টেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বলা বাহুল্য, এ দেশ বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির দেশ। এ দেশে বাঙালি ছাড়া আরও ৫০টির অধিক জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে, যারা স্মরণাতীতকাল থেকেই বসবাস করে আসছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ৫০টি জাতিগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংহতি, সম্প্রীতি, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা বজায় রাখতে হলে এ দেশের অপর জাতিগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণে রাষ্ট্রকে আরও আন্তরিক ও উদ্যোগী হতে হবে।
● ইলিরা দেওয়ান সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন
ইমেইল: [email protected]