দেশে কি কোনো আইনকানুন নেই? বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, কেউ কেউ একসঙ্গে সাত স্ত্রী নিয়ে সুখে সংসার করছেন। বহুবিবাহ করা এই ব্যক্তিদের বিয়েগুলো নিবন্ধিত হয়েছে কি না বা হয়ে থাকলে তা কীভাবে হলো, এগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না।
বহুবিবাহ করা ব্যক্তিরা আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেও বাহবা কুড়াচ্ছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কুষ্টিয়ার ৩৮ বছর বয়সী রবিজুল ইসলামের নাম আলোচিত হচ্ছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর হচ্ছে, সাত স্ত্রীকে নিয়ে রবিজুল সুখে সংসার করছেন। বহুবিবাহের পরিসংখ্যান নিয়ে দেশে কোনো জরিপ বা সেভাবে কোনো গবেষণা না থাকলেও রবিজুলই যে একমাত্র ব্যক্তি নন, তার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।
বহুবিবাহের ক্ষেত্রে ধর্মের বিষয়টিকে সামনে টেনে আনা হয়। ইসলাম ধর্মে একসঙ্গে চার স্ত্রী পর্যন্ত রাখার অনুমতি থাকলেও পবিত্র কোরআনে স্ত্রীদের প্রতি সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য জোর তাগিদও দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এ ধরনের বিয়েকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
গত সোমবার মুঠোফোনে কথা বলি রবিজুলের সঙ্গে। বেশ বীরদর্পের তিনি বললেন, ‘বড় বউ’ তো সব জানেন। দুই মাস আগে সর্বশেষ যে বিয়ে করেছেন, তাতে তাঁর চার স্ত্রী সাক্ষীও দিয়েছেন। তাঁর সংসারে কোনো অশান্তি নেই।
রবিজুল জানান, তিনি মা–বাবার একমাত্র ছেলে। রবিজুল যখন ছোট, তখনই তাঁর মা নাকি ছেলের সাতটি বউ থাকবে, এ–সংক্রান্ত মানত করেছিলেন। মা মারা যাওয়ার আগে রবিজুলের চার স্ত্রীকে দেখে গেছেন। রবিজুলের ভাষায়, মায়ের স্বপ্ন পূরণ এবং ‘গরিব–মিসকিন’ নারীদের সাহায্য করার জন্যই তিনি বিয়েগুলো করেছেন।
রবিজুল মাত্র ১৩ বছর বয়সে এক কিশোরীকে বিয়ে করেছিলেন। গত তিন মাসে তিনটি বিয়ে করেছেন। রবিজুল এক যুগ লিবিয়ায় ছিলেন। সেখানে গিয়েও একটি বিয়ে করেছেন। জানালেন, দোতলা বাড়িতে প্রত্যেক স্ত্রীর আলাদা আলাদা ঘরে খাট, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবিল, শোকেস, টেলিভিশন, ফ্রিজসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন।
চলতি মাসেই গণমাধ্যমের শিরোনামে এসেছেন রাজশাহীর পবা উপজেলার এ এস এম জুবায়ের হোসেন জুয়েল মণ্ডল (২৮)। তিনি ছয়টি বিয়ে করেছেন। দুই স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। এখন আপাতত চার স্ত্রীকে নিয়ে এক বাড়িতে তিনিও নাকি সুখে সংসার করছেন। জুয়েল পেশায় ব্যবসায়ী।
রবিজুল ও জুয়েল দুজনই জানিয়েছেন, কর্মক্ষেত্রে বা ফেসবুকে নারীদের সঙ্গে যোগাযোগের পর তাঁরা বিয়ের সম্পর্কে জড়িয়েছেন। জুয়েল অবশ্য গণমাধ্যমকে বলেছেন, একাধিক স্ত্রী থাকার ফলে বাইরে আর কারও সঙ্গে তাঁকে খারাপ সম্পর্কে লিপ্ত হতে হচ্ছে না।
রবিজুল বা জুয়েলের স্ত্রীরা বোনের মতো থাকছেন বা স্বামীর একাধিক বিয়ের বিষয়টি নাকি তাঁরা মেনেও নিয়েছেন। ‘গরিব-মিসকিন’ পরিবারের এই নারীদের এটা বলা ছাড়া আর তো কোনো উপায়ও নেই।
তবে কেউ কেউ প্রতিবাদও করছেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নোয়াখালীর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক নির্বাহী প্রকৌশলীর স্ত্রী ১৪ মাস বয়সী সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। প্রকৌশলীর স্ত্রী পেশায় চিকিৎসক। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, তাঁর স্বামী তথ্য গোপন করে তাঁকে বিয়ে (তৃতীয় বিয়ে) করেছেন। কিন্তু তাঁকে বা তাঁর সন্তানকে এখন আর স্বীকৃতি দিচ্ছেন না।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে পারিবারিক জীবনের বৃহত্তর সুরক্ষায় বহুবিবাহ আইনের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দেন হাইকোর্ট। স্ত্রীদের মধ্যে সম-অধিকার নিশ্চিত ছাড়া বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থায় আরেকটি বিয়ের অনুমতি দেওয়ার প্রক্রিয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা-ও জানতে চাওয়া হয়। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল দেন।
২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ইশরাত হাসান হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১–এর বহুবিবাহসংক্রান্ত ৬ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটটি করেছিলেন। ধারাটি বলছে, বিবাহিত কোনো পুরুষ সালিসি কাউন্সিলের লিখিত পূর্বানুমতি ছাড়া অন্য কোনো বিয়ে করতে পারবেন না।
অনুমতি ছাড়া অনুষ্ঠিত কোনো বিয়ে ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রিকরণ) আইনের অধীন নিবন্ধন করা যাবে না। আবেদনে আরেকটি বিয়ের কারণ, এ বিয়েতে বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের সম্মতি নেওয়া হয়েছে কি না, তা উল্লেখ থাকবে।
সালিসি কাউন্সিল বিয়েটি প্রয়োজনীয় মনে করলে বিয়েতে সম্মতি দেবে। অনুমতি ছাড়া বিয়ে করলে বর্তমান স্ত্রী অথবা স্ত্রীদের দেনমোহরের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে হবে। পরিশোধ না করলে বকেয়া ভূমি রাজস্বরূপে তা আদায়যোগ্য হবে। স্বামী অনুমতি না নেওয়ার অভিযোগে অপরাধী সাব্যস্ত হলে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
আইনজীবী ইশরাত হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রিটের শুনানি নিয়ে আদালত রুল দিয়েছেন। চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় আছে বিষয়টি।
তিনি আরও বলেন, বিয়ে বলবৎ অবস্থায় সালিসি কাউন্সিলের অনুমতি নিয়ে আরেকটি বিয়ে করা যায়। তবে স্ত্রীর ভরণপোষণসহ অন্য প্রমাণাদি যাচাই ও খোরপোশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সালিসি কাউন্সিলের নেই। এতে নারীর সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
সাত বিয়ে বা চার বিয়ে করা প্রসঙ্গে ইশরাত হাসান বলেন, শরিয়াহ আইন বা দেশের আইন, সামাজিক দৃষ্টিকোণ—কোনো দিক দিয়েই এসব বিয়ে গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যক্তির স্বাধীনতা, যার জীবন তার—এমন ধারণায় এসব নিয়ে বেশির ভাগ সময়ই কেউ কথা বলেন না। অথচ এ ধরনের বিয়ের কারণে নারী ও শিশুরা বেশি সমস্যায় পড়ছে।
এমন বিয়ের নিবন্ধন থাকে না, নিবন্ধন করলেও মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে বিয়ে নিবন্ধন হচ্ছে। স্বামী বিয়েটা অস্বীকার করলে স্ত্রীর ভরণপোষণ এবং সন্তানের উত্তরাধিকার সম্পত্তি পাওয়ার যে অধিকার, তা পাইয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। তাই আইনবহির্ভূতভাবে যাঁরা বিয়ে করছেন এবং বিয়ের কাজিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি কার্যকর করতে হবে।
বহুবিবাহের বিষয়টিকে এখনো মজা, বিনোদন বা তেমন বড় কোনো বিষয় নয় বলেই ভাবা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ইশরাত হাসান। তিনি বলেন, এতে একজনকে দেখে আরেকজন বহুবিবাহ করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। অথচ অনেক মুসলিমপ্রধান দেশে বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বহুবিবাহের কারণে স্ত্রী বা নারীদের বিভিন্ন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পাকিস্তানি আইনজীবী রাফিয়া জাকারিয়া ‘দ্য প্রবলেমস অব পলিগামি’ নামে প্রকাশিত নিবন্ধে স্বামীর বহুবিবাহের কারণে নারীদের মানসিক, শারীরিক, অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেছেন।
গত বছরের ১১ মে বিবিসি নিউজ, দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ভারতে বহুবিবাহ বন্ধের জন্য লড়ছেন যে মুসলিম নারীরা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের মুসলিমদের মধ্যে বহুবিবাহের প্রথার প্রতি আরও একবার সবার নজর পড়েছে ২৮ বছর বয়সী রেশমার করা এক মামলার ফলে।
রেশমার স্বামী মোহাম্মদ শোয়েব খান তাঁর স্ত্রীর কোনো লিখিত অনুমতি না নিয়েই আরেকটি বিয়ে করতে গিয়েছিলেন। দিল্লি হাইকোর্টে ওই মামলা করার সময় রেশমা স্বামীর বিরুদ্ধে পারিবারিক সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা, হয়রানি ও যৌতুক দাবির অভিযোগ এনেছিলেন। রেশমা ও তাঁর সন্তানকে ত্যাগ করে স্বামী আরেকটি বিয়ে করার পরিকল্পনা করছেন বলে জানিয়েছিলেন।
২০২১ সালের ৩ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা ‘আবার বিয়ে: আইনের কথা’ শিরোনামের এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, হিন্দু ও ইসলাম—দুই ধর্মেই বহুবিবাহের অনুমতি রয়েছে শুধু পুরুষদের ক্ষেত্রে। আইনানুগভাবে বিবাহবিচ্ছেদ করলে পুরুষ বা নারীর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা একাধিক বিয়ে করতে কোনো বাধা নেই।
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, স্বামী থাকা অবস্থায় স্ত্রী যদি আবার বিয়ে করেন, তাহলে সেই দ্বিতীয় বিয়ে আইনত অবৈধ, অকার্যকর ও বাতিল বলে গণ্য হবে। স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করতে হবে। এই বিধান লঙ্ঘন করলে প্রথম স্বামী সেই স্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৫ ধারায় বলা আছে, এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা। তবে দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারার বিধানের ব্যতিক্রম হিসেবে স্ত্রী যদি তাঁর আগের স্বামীর সাত বছর যাবৎ কোনো খোঁজখবর না পান, অথবা তিনি জীবিত থাকতে পারেন—এমন কোনো তথ্য যদি জানা না যায়, তাহলে পরবর্তী স্বামীকে সত্য ঘটনা জানিয়ে বিয়ে করতে পারবেন।
আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, বহুবিবাহের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষে বৈষম্য করা হয়েছে। পুরুষ অনুমতি ছাড়া বিয়ে করলে ১ বছরের কারাদণ্ড আর নারীর বেলায় তা ৭ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
দেশে–বিদেশে বহুবিবাহ বন্ধের বিষয়টি বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একমাত্র নারী সদস্য রাজিয়া বানু ১৯৭২ সালের ২৭ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর দেওয়া বক্তৃতায় বহুবিবাহ বন্ধ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছিলেন। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের গুজরাটের হাইকোর্ট অভিন্ন দেওয়ানি দণ্ডবিধি তৈরি ও মুসলিম বহুবিবাহ প্রথা বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ভারতের মুসলিম সমাজে বহুবিবাহ প্রথাকে ‘চরম জঘন্য পিতৃতান্ত্রিক’ আচরণ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন আদালত।
২০২১ সালের ১৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন প্রথম আলোয় ‘বহুবিবাহের বিধানগুলো নতুন করে পর্যালোচনা দরকার’ শিরোনামের মতামতে উল্লেখ করেছেন, ২০১৯ সালে মিসরের শীর্ষ ইসলামিক প্রতিষ্ঠান আল-আজহারের প্রধান ইমাম ফতোয়া দেন যে বহুবিবাহ নারীর প্রতি ন্যায়বিচার করে না। যাঁরা বহুবিবাহকে সমর্থন করেন, তাঁরা ইসলামের ভুল অনুশীলন করছেন।
তিনি বলেন, ইসলামে একাধিক নারীকে বিয়ে করা যাবে তখনই, যখন তাঁদের সবার প্রতি ন্যায্যতা দেখানো সম্ভব হবে। কিন্তু বহুবিবাহের মাধ্যমে তা করা সম্ভব নয় (দ্য ইনডিপেনডেন্ট, ৩ মার্চ ২০১৯)। অনেক দিন থেকেই মিসরসহ বিশ্বের অনেক মুসলিমপ্রধান দেশে বহুবিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামি আইনের এ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
তবে রবিজুল বা জুয়েলরা প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক বিয়ে করেই চলছেন। তাঁদের ঠেকানোর কেউ নেই।
মানসুরা হোসাইন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক