গাজায় এখন যে ইসরায়েলি হামলা হচ্ছে, তার ৯ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৪ সালে একই এলাকায় ইসরায়েল ‘অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ’ নামের একটি সামরিক অভিযান চালিয়েছিল। ৫১ দিন ধরে চালানো সেই অভিযানে ২ হাজার ২৫১ জন ফিলিস্তিনি নাগরিককে তারা হত্যা করেছিল, যাদের মধ্যে শিশুই ছিল ৫৫১ জন।
২০১৪ সালের ওই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের অল্প কিছুদিন পর বার্সেলোনায় বাস করেন, আমার এমন একজন পরিচিত মনস্তত্ত্ববিদ আমাকে কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছিলেন। ছবিগুলো হাতে আঁকা। সেগুলো গাজা থেকে তাঁর হাতে এসেছিল। ছবিগুলো এঁকেছিল ইসরায়েলের সীমান্তসংলগ্ন গাজা শাসিত খান ইউনিস এলাকার খুজা শহরের শিশুরা।
ছবিগুলোর দিকে প্রথমে তাকালে সেগুলোকে সাধারণ বাচ্চাকাচ্চাদের আঁকা সাধারণ ছবি মনে হবে। বিভিন্ন রঙের বাড়ির ছবি, বাড়ির পাশে ঘাসে ভরা মাঠ, আকাশে মেঘ, সূর্য—এই সব। কিন্তু একটু খেয়াল করেই চমকে গেলাম। সেই সব মেঘ, সূর্য, বাড়িঘরের পাশাপাশি প্রতিটি ছবিতে মিসাইল, ট্যাংক, বুলডোজার এবং জেট বিমানের মতো যুদ্ধের সরঞ্জাম আছে। আর সেই যুদ্ধ সরঞ্জামের লক্ষ্য সেই বাড়িঘর।
ছবিগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সেগুলো তুলতুলে আনাড়ি হাতে আঁকা। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছিল, কমলা রঙের একটা বাড়ির ওপরে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়ছে, আর একটা ক্ষেপণাস্ত্র সেই বাড়ির দিকে আকাশ থেকে নেমে আসছে। আর একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, হাসি হাসি মুখ করা এক দল লোকের ওপর বিমান থেকে ছোড়া একটা ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি শিশুরা যে কী মারাত্মক ট্রমা বা মানসিক আতঙ্ক ও যন্ত্রণা নিয়ে বেড়ে ওঠে, তার একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ ছিল ওই ছবি। গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের ধ্বংসলীলা সেখানকার শিশুদের মনোজগতে যে কী নিদারুণ আতঙ্ক স্থায়ীভাবে রুয়ে দিয়েছে, তার বড় প্রমাণ এই ছবি। যে শিশুরা ছবিগুলো এঁকেছিল, তারা এখন কিশোর–কিশোরী। খবর পেয়েছি, গাজায় চলমান হামলার মধ্যেও (চলমান হামলায় এখন পর্যন্ত সেখানে প্রায় ১০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৪৮০০ জনের বেশিই শিশু) তারা এখনো বেঁচে আছে।
অবরুদ্ধ গাজায় এমন কোনো নিরাপদ জায়গা নেই যেখানে সেখানকার শিশুরা আশ্রয় নিতে পারে। বাড়িঘর-স্কুল কলেজ-হাসপাতাল—কোনো কিছুই ইসরায়েলি বোমার নিশানা থেকে বাদ পড়ছে না। ইসরায়েলের সামরিক কর্মকর্তারা বেশ খোলামেলাভাবেই বলছেন, তাঁরা গাজাকে ফিলিস্তিনিশূন্য করতে চান।
এ অবস্থায় আক্ষরিক অর্থেই গাজাবাসী জাগ্রত অবস্থায়ও ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি ইসরায়েলি বিমানগুলো যখন বোমা ফেলায় মাঝেমধ্যে বিরতি নিচ্ছে, তখনো তঁারা মানসিক আতঙ্কে কেঁপে উঠছেন।
পাঁচ বছর আগে নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি) একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, গাজার তরুণ সম্প্রদায়ের ‘মানসিক স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্ত্বিক অবনমন’ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ২০২০ সালে অবরুদ্ধ এই উপত্যকার বেশির ভাগ শিশুর মধ্যে আতঙ্কজনিত রোগ লক্ষণ পিটিএসডি (পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) ধরা পড়েছে।
২০২১ সালে গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় যে ৬০ জন ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছিল, তাদের মধ্যে ১২ জন ছিল এমন শিশু, যাদের যুদ্ধাতঙ্কের জন্য এনআরসি সাইকোলজিক্যাল প্রোগ্রামের আওতায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের শারীরিকভাবে হত্যা করার পাশাপাশি তারা গাজায় খুব ঠান্ডা মাথায় ছক কষে মনস্তাত্ত্বিক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোরও চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটি করতে গিয়ে তারা গাজায় যা করছে, সেটিকে ইংরেজিতে ব্যবহার্য ‘সাইওপ’ (‘সাইকোলজিক্যাল অপারেশন’–এর সংক্ষিপ্ত রূপ) টার্ম দিয়ে বোঝানো যাবে না।
আসলে তারা সাইওপের চেয়ে বেশি কিছু করছে। মেরিয়াম-ওয়েবস্টার ডিকশনারি অনুযায়ী, যুদ্ধ সরঞ্জাম নয় এমন কিছু ব্যবহার করে (যেমন সামরিক অভিযানের সতর্কবার্তা দেওয়া লিফলেট ছড়িয়ে দেওয়া) শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টাকে সাইওপ বলে।
হামলা চালানোর আগাম বার্তা দিয়ে জায়গা খালি করে দিতে বলে ইসরায়েল ফিলিস্তিন ও লেবাননে বিমান থেকে লিফলেট ফেলার চর্চা অনেক আগে থেকে করে আসছে। এখনকার দিনে তারা মোবাইল ফোনে দ্রুত জায়গা খালি করে দেওয়ার বার্তা পাঠিয়ে থাকে।
গাজা যেহেতু চারদিক থেকে আটকানো এবং পালানোর কোনো জায়গাই নেই, সেখানে এ ধরনের লিফলেট ছড়ানো মনস্তাত্ত্বিকভাবে গাজাবাসীকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। তঁাদের জন্য এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ আরও যন্ত্রণাময় হয়ে ওঠে।
১৭ বছর ধরে গাজা উপত্যকাকে অন্যায়ভাবে ইসরায়েল চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এর ফলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য তাদের ওপর চেপে বসেছে, যা তঁাদের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষাদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। খাবার ও পানির অভাব এবং গ্যাস-বিদ্যুতের কৃত্রিম সংকট ফিলিস্তিনিদের মানসিক যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আর এর সবকিছুই ইসরায়েল করছে ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ মেয়াদে বিষণ্ন ও বিপর্যস্ত করে দেওয়ার জন্য।
গাজা কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ড. আয়াদ আল সাররাজ একবার একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘মানুষ এই প্রকৃতি ও পরিবেশের সন্তান। আপনি যদি কারও ওপর অসহায়ত্ব ও বিষাদ দিয়ে তাকে সার্বক্ষণিকভাবে ঢেকে দেন, তাহলে সে স্বাভাবিক জীবন কী তা বুঝতেই পারবে না।
গাজাবাসীকে যেভাবে বোমা, হত্যা, রক্ত, অবমাননায় আচ্ছাদিত করে দেওয়া হয়েছে, তাতে নতুন প্রজন্মের কাছে মৃত্যুকেই জীবনের শুরু বলে মনে হতে পারে। পাল্টা আঘাত হানা তঁাদের সহজাত প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠতে পারে।
ইসরায়েল বর্তমানে গাজাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনে যে ‘মনস্তাত্ত্বিক অভিযান’ চালাচ্ছে, এর প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি শিশুদের মনোজগৎ অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
● বেলেন ফার্নান্দেজ রাজনৈতিক লেখক ও আল–জাজিরার নিয়মিত কলাম লেখক