২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

মানবাধিকার সরকারের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ

কারাগারের দেয়ালে সাঁটানো বন্দী তালিকায় গ্রেপ্তারের পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের নাম খুঁজছেন স্বজনেরা।
ছবি : প্রথম আলো

১৩ নভেম্বর ২০২৩ ‍চতুর্থবার জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার ব্যবস্থা ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) বা সর্বজনীন পুনর্বীক্ষণ পদ্ধতির আওতায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচিত হতে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া ২০০৬ সালে চালু হয়েছে। ২০০৯ সালে প্রথমবার, ২০১৩ সালে দ্বিতীয় ও ২০১৮ সালে তৃতীয়বার বাংলাদেশ এ প্রক্রিয়ার আওতায় পর্যালোচিত হয়েছে।

মূলত মানবাধিকার পরিষদ এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতি সাড়ে চার বছর পরপর পর্যালোচনা করে থাকে। পর্যালোচনায় বিভিন্ন সদস্যরাষ্ট্র পর্যালোচনাধীন রাষ্ট্রকে মানবাধিকার–সংক্রান্ত নানা বিষয়ে সুপারিশ করে। জাতিসংঘের অন্যান্য মানবাধিকার ব্যবস্থার তুলনায় রাষ্ট্রসহ অংশীজনদের কাছে এ প্রক্রিয়াটির অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

১. সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জাতীয় প্রতিবেদন, ২. জাতিসংঘের বিভিন্ন তথ্যের সমন্বয়ে মানবাধিকার-সংক্রান্ত হাইকমিশনের কার্যালয় কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সংকলন ও ৩. জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বা সংগঠনের জোটগুলো কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিবেদনগুলো থেকে মানবাধিকার-সংক্রান্ত হাইকমিশনের কার্যালয় কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সংকলন—এ তিন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এ পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

এ প্রতিবেদনগুলো থেকে সদস্যরাষ্ট্রগুলো রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সুপারিশ পর্যালোচনাধীন রাষ্ট্রকে প্রদান করে থাকে। মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের গৃহীত উদ্যোগগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি সরকার প্রদত্ত সুপারিশগুলো সমর্থন করতে পারে কিংবা নোট রাখতে পারে, যার অর্থ এ সুপারিশগুলো সরকার এ মুহূর্তে সমর্থন না করলেও ভবিষ্যতে সমর্থন করার পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

আরও পড়ুন

ইতিমধ্যে এ পর্যালোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য সরকার, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বা সংগঠনের জোটগুলো প্রতিবেদন প্রদান করেছে, যা জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত হাইকমিশনের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এবার দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বা সংগঠনগুলোর জোট থেকে ৩৯টি অংশীজনদের প্রতিবেদন জমা পড়েছে।

এ ছাড়া বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, সুইডেন, উরুগুয়েসহ বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে তাদের প্রশ্নগুলো জমা দিয়েছে, যেখানে গুমসংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ অনুমোদন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সংগঠনগুলোর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিতকরণসহ নানা বিষয়ের ওপর আলোচনা করা হয়েছে। এবারের পর্যালোচনায় প্রশ্ন ও সুপারিশ প্রদানের জন্য ১১৪টি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

সরকার প্রদত্ত জাতীয় প্রতিবেদনে মূলত তৃতীয়বারের পর্যালোচনার সময় গৃহীত ১৭৮টি সুপারিশ বাস্তবায়নে তারা নানা উদ্যোগ বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে উল্লেখ করেছে। তবে জাতীয় প্রতিবেদনে উল্লিখিত এসব পদক্ষেপ পর্যাপ্ত কি না, বা সেগুলোর ফলপ্রসূতা নিয়ে অনেকেরই দ্বিমত রয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) ২০০৭ সালে এ প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে জাতীয় পর্যায়ে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০টি মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ ফোরাম সক্রিয়ভাবে এ প্রক্রিয়ার তিনটি পর্বে অংশগ্রহণ করেছে এবং জাতীয় পর্যায়ে ও জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
চতুর্থ পর্যায়ের জন্যও ফোরাম বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে মানবাধিকার পরিষদে জমা দিয়েছে।

প্রেরণের আগে প্রতিবেদনটি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিনিময় করা হয়। অন্যান্য বারের মতো এবারও ফোরামের একটি প্রতিনিধিদল জেনেভায় বাংলাদেশের পর্যালোচনাকালে উপস্থিত থাকবে। এ প্রতিনিধিদলে ফোরাম সচিবালয় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও ফোরামের সদস্য সংগঠন নাগরিক উদ্যোগ, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি এবং কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিরা রয়েছেন।

বর্তমান সরকার ধারাবাহিকভাবে চতুর্থবার এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার আওতায় ও মানবাধিকার পরিষদের সদস্যপদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় মানবাধিকার-সংক্রান্ত যে অঙ্গীকারগুলো সরকার তুলে ধরেছে, তা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তার একটি প্রকৃত চিত্র এ পর্যালোচনায় উঠে আসবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতপূর্ণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে সংঘর্ষ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে এবং গণগ্রেপ্তারের বা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়ের অভিযোগ উঠেছে। জনমনে চরম আতঙ্কও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র আরও সংকুচিত হয়ে পড়ছে ও শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকারে বাধা আরোপ করার অভিযোগ তীব্রতর হয়ে উঠেছে।

নানামুখী সমালোচনার মুখে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ তৈরি করেছে, কিন্তু নতুন এ আইনেও একইভাবে মতপ্রকাশের অধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার সুযোগ রয়ে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, কেবল আইনের নাম পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু আইনের মূল চরিত্র, ধারাগুলো প্রায় একই রয়ে গেছে। খসড়া তথ্য সুরক্ষা আইন নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মতামত নেওয়ার পরও এখনো ব্যক্তির ও ব্যক্তিগত উপাত্তের সংজ্ঞা সুস্পষ্টকরণ এবং বিচারিক নজরদারির মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়নি বলে এ আইনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করার সুযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে সরকার একাধিকবার বৈষম্য নিরোধ আইন প্রণয়নের অঙ্গীকার করলেও এ-সংক্রান্ত বিলটি এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এবারের পর্যালোচনায় নারী-শিশু, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, লৈঙ্গিক সংখ্যালঘুসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার, প্রাতিষ্ঠানিক অকার্যকারিতা, নজরদারিকেন্দ্রিক আইনের মাধ্যমে অধিকার হরণের সুযোগ, বিশেষ করে গণমাধ্যম, বাক্‌স্বাধীনতা, সংগঠনের অধিকার, শ্রম অধিকার হরণ, ভোটাধিকারে সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রের অনুপস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে সরকার নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে।

জাতিসংঘ অংশীজনদের প্রতিবেদনের যে সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে, সেখানে এসব বিষয়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের প্রভাব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অস্বচ্ছ সদস্য নিয়োগপ্রক্রিয়া ও প্যারিস নীতিমালার সঙ্গে অসামঞ্জস্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্যাতনের অভিযোগগুলো অস্বীকার করা বা এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বা জবাবদিহি নিশ্চিত না হওয়া, নাগরিক সংগঠন, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকদের হয়রানির অভিযোগসহ বিদ্যমান নানা প্রতিবন্ধকতা বা উদ্বেগের বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

এ ছাড়া শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় পৃথক অধিদপ্তর গঠন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ সংশোধন, সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় দ্রুততার সঙ্গে নিরপেক্ষ তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করা, দলিত ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর নজরদারি বাড়ানোর বিষয়ে বলা হয়েছে।

সরকার প্রদত্ত জাতীয় প্রতিবেদনে মূলত তৃতীয়বারের পর্যালোচনার সময় গৃহীত ১৭৮টি সুপারিশ বাস্তবায়নে তারা নানা উদ্যোগ বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে উল্লেখ করেছে। তবে জাতীয় প্রতিবেদনে উল্লিখিত এসব পদক্ষেপ পর্যাপ্ত কি না, বা সেগুলোর ফলপ্রসূতা নিয়ে অনেকেরই দ্বিমত রয়েছে।

উল্লেখ্য, এ প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য অংশগ্রহণমূলক আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মানবাধিকার-সংক্রান্ত জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং এভাবে জাতীয় পর্যায়ে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিবর্তনমূলক আইন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দলীয়করণ ও দখলদারির মাধ্যমে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে যেভাবে খাদের কিনারায় ধাবিত করা হয়েছে, তার থেকে উত্তরণে ব্যর্থ হলে যেমন স্বাধীন বাংলাদেশে ন্যায়বিচার, সমতা ও মৌলিক অধিকারভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন আরও পদদলিত হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশ ও সরকারকে অধিকতর বিব্রত হতে হবে।

তাই সরকারের উচিত মানবাধিকার-সংক্রান্ত অভিযোগগুলো অস্বীকার করার বর্তমান প্রবণতা থেকে বের হয়ে এসে যথাযথ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)–এর সদস্য সংগঠনগুলো হচ্ছে—আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-সচিবালয়, অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্মস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (বিএসডব্লিউএস), বাংলাদেশ দলিত অ্যান্ড এক্সক্লুডেড রাইটস সোসাইটি (বিডিআরএম), বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ফেয়ার, কর্মজীবী নারী, কাপেং ফাউন্ডেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নাগরিক উদ্যোগ, নারীপক্ষ, ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব ডিজঅ্যাবল্ড পিপলস অর্গানাইজেশনস (ন্যাডপো), নিজেরা করি, স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট (স্টেপস), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং ওমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন।