চীনকে শায়েস্তা করতে গিয়ে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকেই বিপদে ফেলবেন ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর মন্ত্রিপরিষদের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যাঁদের মনোনয়ন দিয়েছেন, তা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি নির্বাচনী প্রচারে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নে তিনি বদ্ধপরিকর।

নেতাদের নির্বাচিত হওয়ার আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি নির্বাচিত হওয়ার পর বাস্তবায়ন না করা দেখতে দেখতে যাঁরা বিরক্ত ও ক্লান্ত, তাঁদের কাছে ট্রাম্পের এসব উদ্যোগ একটি ইতিবাচক চমক মনে হতে পারে।

তবে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি মনে করি, ট্রাম্পের নীতি তাঁর ও তাঁর সমর্থকদের প্রত্যাশা শেষ পর্যন্ত পূরণ করতে সক্ষম হবে না।

অভিবাসন আইন ঠিকভাবে মানা যে কোনো দেশের জন্য ভালো, কিন্তু যারা আগে থেকেই অবৈধভাবে দেশে আছে, তাদের তাড়ানোর বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদি এমন কিছু করা হয় যাতে অভিবাসীরা আসতে ভয় পান, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় সুবিধা হারাতে পারে। ইউরোপ আর জাপানের মতো অনেক দেশের জনসংখ্যা কমছে। অবৈধ অভিবাসীদের ওপর নির্বিচারে চড়াও হলে যুক্তরাষ্ট্রকেও এই সমস্যায় পড়তে হতে পারে। কিন্তু এই সমস্যা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বাঁচতে হবে। কারণ শ্রমশক্তি ঠিক রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কর্মী দরকার হবে।

ট্রাম্পের অন্য বড় দুটি প্রতিশ্রুতির দিকে তাকান: উল্লেখযোগ্য কর হ্রাস এবং বিশ্ব থেকে আমদানি পণ্যের ওপর ১০-২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ (চীনা পণ্যের ক্ষেত্রে এটি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে)।

অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও শুল্ক আরোপের বিষয়ে প্রায় সবাই একমত। খুব কম অর্থনীতিবিদই এটিকে ভালো কোনো ধারণা মনে করেন; কারণ এর মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যায়, এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং, এর ফলে যে জনগণের ওপর খরচের বোঝা বাড়ে এবং সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তা অত্যন্ত সুপরিচিত।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর বিশ্লেষক মার্টিন উলফ এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, একটি দেশের ‘পেমেন্ট ভারসাম্য’ মানে এমন একটি হিসাব যা সব সময় সমান হতে হবে। যদি কোনো দেশে বাণিজ্যে ঘাটতি (আমদানি বেশি, রপ্তানি কম) থাকে, তাহলে সেই ঘাটতি পুষিয়ে দিতে বিদেশ থেকে বিনিয়োগ বা পুঁজি আসতে হবে। এভাবেই দেশের সামগ্রিক আর্থিক ভারসাম্য ঠিক রাখা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র যদি দেশ ‘এ’ থেকে আমদানি কমানোর জন্য শুল্ক আরোপ করে, তাহলে তাকে দেশ ‘বি’ এবং ‘সি’ থেকে সেই পণ্যগুলো কিনতে হবে, যদি না তারা খরচ বা চাহিদা কমায়।

ট্রাম্প আগেও চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক বসিয়েছিলেন, তখনো এমনটাই হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র সেই একই পণ্য অন্য দেশ থেকে কিনেছিল, আর সেই দেশগুলো আবার চীন থেকে কিনেছিল।

যদি ট্রাম্প এবার অন্য দেশগুলোর ওপরও শুল্ক বসান, তাহলে এই ঘটনা আবারও ঘটবে।

এটি এড়ানোর কোনো উপায় নেই। যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই তার মোট আমদানি কমাতে চায়, তাহলে তাকে মোট অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমাতে হবে। অথবা, আরও সঠিকভাবে বললে বলা যায়, দেশটিকে তার সঞ্চয় বাড়াতে হবে যাতে তার বিনিয়োগের চাহিদার তুলনায় বিদেশ থেকে কম পুঁজি আসে।

এবার ট্রাম্পের কর হ্রাস এবং নির্বাচনে যাঁরা তাঁকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিগুলোর কথা ভাবুন।

ট্রাম্প যদি এসব পদক্ষেপ নেন এবং যদি অন্য সবকিছু যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াবে। আর যদি এগুলো শুল্কের সঙ্গে একত্রে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তা জীবনযাত্রার খরচ অনেক বাড়িয়ে দেবে।

জো বাইডেনের প্রশাসনের সময় যেসব ভোটার মুদ্রাস্ফীতিতে বিরক্ত হয়ে ছিলেন, তাঁদের জন্য এখন কিছুটা স্বস্তি এসেছে। কিন্তু ট্রাম্পের নীতিগুলো দাম আবার বাড়িয়ে দিতে পারে।

আর এর আগেই যদি অন্যান্য দেশ শুল্ক আরোপ করে বসে, তাহলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যেমন চীন ও অন্য দেশগুলো আগেরবার যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল।

এখন কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের এই অদ্ভুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে অন্য দেশগুলোর নেতারা কী শিখতে পারেন?

ট্রাম্পের অস্বাভাবিক রাজনৈতিক কৌশল এখন অনেক জায়গায় জনপ্রিয়। এ কারণে আমরা বিভিন্ন দেশে আরও অনেক ‘ট্রাম্পধর্মী উদ্যোগ’ দেখতে পাব। কিন্তু সেগুলোও তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে না। কারণ, অন্য সব দেশেরও পেমেন্ট ভারসাম্যের একই সমীকরণ রয়েছে এবং যেসব দেশের বড় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে, তারা তাদের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের চাহিদার তুলনায় বেশি পুঁজি রপ্তানি করে।

ট্রাম্প গদিতে আসীন হওয়ার পরপরই বিচক্ষণ বিদেশি নেতাদের উচিত তাদের দেশের দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পরিকল্পনা শুরু করা।

যারা বেশি সঞ্চয় করছে, তাদের উচিত দেশের মধ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর উপায় খোঁজা অথবা সঞ্চয়ের হার কমানো।

উদাহরণস্বরূপ, জার্মানি এবং চীন যদি এমন কৌশল গ্রহণ করে, তাহলে তা তাদের অর্থনীতিকে চাঙা করবে এবং তাদের নেতাদের জনপ্রিয়তা বাড়াবে। একই সঙ্গে তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশে পুঁজি রপ্তানি কমিয়ে আনবে।

এরপর আরও অনেক গঠনমূলক নীতি পরিবর্তন হতে পারে। যেমন, চীন তার আর্থিক খাত সংস্কার করতে পারে এবং তার মুদ্রাকে এমন বৈশিষ্ট্য দিতে পারে যা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্ব থেকে পুঁজি আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা তখন অন্য দেশগুলোর ওপর শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কম ঔদ্ধত্য দেখাবেন। কারণ তখন অন্য দেশগুলো আর যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মুদ্রার ওপর এতটা নির্ভরশীল থাকবে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • জিম ও’নিল গোল্ডম্যান স্যাকস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী।