ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম মার খাচ্ছেন, সাপ বা জন্তু-জানোয়ারকে পেটানোর সময় কিছু মানুষের যে দেহভঙ্গি দেখা যায়, সেই একই কায়দায় নৌকার ব্যাজধারী লোকজনকে দেখা গেল তাঁর ওপর চড়াও হতে। তাঁরা হিরো আলমের সাদা পাঞ্জাবি ধরে টানছেন, ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, লাথি মারছেন, মাথার ওপর ধরেছেন উঁচু লাঠি। হিরো আলম ছুটে রিকশায় ওঠার চেষ্টা করলেন, ধাওয়া খেয়ে রিকশা থেকে নেমে আবার দৌড়। এরপর তিনি একটি হাসপাতাল থেকে লাইভ দিয়েছেন।
এই হলো ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের নির্বাচনী হালচাল। তবে এসব ছাপিয়ে পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এর আগে, ৪ জুলাই নির্বাচন কমিশন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আইনশৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকসহ অন্যদের সঙ্গে বসেছিল। আড়াই ঘণ্টার বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ১০০ ভাগ গ্যারান্টি দিলাম। আপনারা ১৭ তারিখের নির্বাচন দেখেন। আমাদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ পান কি না। যদি না পান, তখন আমাকে বইলেন। তখন আমি ডিএমপি কমিশনার হিসেবে নাকে খত দিয়ে চলে যাব।’
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে বনানী বিদ্যানিকেতনে বেলা সোয়া তিনটায়। এর আগে ঢাকা মহানগর পুলিশ থেকে পাঠানো খুদে বার্তায় সাংবাদিকদের জানানো হয়, ‘মান্যবর ডিএমপি কমিশনার জনাব খন্দকার গোলাম ফারুক, বিপিএম-বার, পিপিএম অদ্য দুপুর ২:০০ ঘটিকায় বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভোটকেন্দ্রে ভোটদান ও পরিদর্শনে যাবেন।’
অর্থাৎ ‘মান্যবর ডিএমপি কমিশনার’ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সোয়া এক ঘণ্টার ভেতরেই হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। বনানী বিদ্যানিকেতনের বাইরে হিরো আলমকে মারধর ও চিৎকার–চেঁচামেচির মধ্যেও আশ্চর্য নিরুত্তাপ ছিল পুলিশ। তার চেয়েও বড় কথা, নৌকার ব্যাজধারীদের কাছে পুলিশ হিরো আলমকে তুলে দিয়েছে বললেও ভুল হবে না।
এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিএমপি কমিশনারকে খুঁজতে শুরু করেছেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। তাঁরা ডিএমপি কমিশনারের নাকে খত দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ডিএমপি কমিশনার এখন কী করবেন? তিনি কি ‘ইনার কর্ডন’–এর দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ও সহযোগীদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, নাকি তাঁদের নেতা হিসেবে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন?
কেন্দ্রের ভেতরে ধারণ করা ভিডিও এর প্রমাণ। ‘ইত্তেফাক’–এর ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হিরো আলমকে বেশ কিছু লোক ঘিরে ধরে আছেন। তাঁরা তাঁকে হয়রানি করছেন, মারতে উদ্যত। এ সময় একজন সাংবাদিক দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছে ছুটে যান। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘হিরো আলমের ওপর হাত তুলছে, আপনারা দেখছেন না কেন?’ তখন একজন পুলিশ হিরো আলমের দিকে এগিয়ে যান। আশ্বস্ত করার স্টাইলে হিরো আলমের ঘাড়ে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে বনানী বিদ্যানিকেতনের ফটকের দিকে এগোতে থাকেন ওই পুলিশ। তারপর ফটকের বাইরে গিয়ে নৌকার ব্যাজধারী লোকজনের হাতে তাঁকে (হিরো আলম) ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার কেন্দ্রে ঢুকে পড়েন।
ইউনিফর্মধারী পুলিশের ওই কর্তাকে এ সময় সাংবাদিকেরা বলেন, হিরো আলমকে মারধর করা হচ্ছে। আপনারা দেখবেন না? জবাবে তিনি বলেন, ‘ইনার কর্ডন আমার, ইনার কর্ডন। আউটার কর্ডন আমার না। আমার দায়িত্ব ভেন্যুর ভেতরে, বাইরে না।’
নির্বাচনে প্রার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। যখন দেখা গেল প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখন ‘ইনার কর্ডন’–এর দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল তাঁকে কেন্দ্রের ভেতরে রেখে নিরাপত্তা দেওয়া। প্রয়োজনে অতিরিক্ত পুলিশ ডেকে তাদের দায়িত্বে বা হেফাজতে হিরো আলমকে কেন্দ্রে থেকে বের করার উদ্যোগ নেওয়া। কিন্তু ‘আউটার কর্ডন আমরা না’ বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা সহিংস নৌকার ব্যাজধারীদের হাতে প্রার্থীকে তুলে দিয়ে নিরপেক্ষতার অনন্য নজির রাখলেন!
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী নির্বাচনের সময় পুলিশ নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে। তবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে পুলিশকে এই আদেশে রীতিমতো অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবে, যুক্তিসংগতভাবে শক্তি প্রয়োগ, বলপ্রয়োগসহ যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে। এই আদেশেই বলা আছে, ইচ্ছাকৃতভাবে বা যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কোনো কাজ বা বিচ্যুতির মাধ্যমে দায়িত্বে অবহেলা করলে জেল-জরিমানা হবে।
এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিএমপি কমিশনারকে খুঁজতে শুরু করেছেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। তাঁরা ডিএমপি কমিশনারের নাকে খত দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ডিএমপি কমিশনার এখন কী করবেন? তিনি কি ‘ইনার কর্ডন’–এর দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ও সহযোগীদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, নাকি তাঁদের নেতা হিসেবে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন?
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ইমেইল: [email protected]