কলাম‘যদু ডাক্তারের পেশেন্ট’ নামে পরশুরামের একটা গল্প আছে। পঞ্চী আর জটারাম নামের প্রেমিক–প্রেমিকা দুজনের ধড় থেকে মাথা আলগা করে দেয় একজন কোপ মেরে। বাবা বিঘোরানন্দের কল্যাণে এরা বেঁচে যায়। তবে পাকচক্রে একজনের মাথা আরেকজনের জোড়া লাগানো হয়। দেহ একজনের। মাথা আরেকজনের। এখন কে তাহলে জটারাম আর কে পঞ্চী? বিঘোর বাবা বললেন, ‘মাথা হলো উত্তমাঙ্গ। মাথা অনুসারেই লোকের নাম হয়, ধড় যারই হোক।’
আসলেও আমরা ধড়ের ওপর এক আশ্চর্য জিনিস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর মনের বাস যে মস্তিষ্কের মধ্যে, সে তো জগতের জটিলতম ব্যাপার। মস্তিষ্কে থাকে নার্ভ সেল। এর নাম নিউরন। এই নিউরন সারা দেহে বার্তা পাঠায়। সেই বার্তা মেনে আমরা খাই, ঘুমাই, চিন্তা করি, কথা বলি, হাঁটাচলা করি। আমাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কে এই নিউরনের সংখ্যা ৮৯ বিলিয়ন! এরা প্রত্যেকে আশপাশের আরও প্রায় ৭ হাজার নিউরনের সঙ্গে যুক্ত থাকে আর প্রতি সেকেন্ডে ১০ থেকে ১০০ সংকেত পাঠায়।
রাষ্ট্রের মধ্যে যখন ক্ষমতা আর জনগণের সম্পর্কে অচলাবস্থা চলতে থাকে, তখন ঝটকা মেরে তার সমাধান করে দেন একজোট হওয়া মানুষ। এই হচ্ছে সেই ক্ষণ, যখন মানুষ হয়ে ওঠে জনতা। ২০২৪–এর জুলাই–আগস্টে আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি
এই মাথাওয়ালা মানুষ একলা একরকম আচরণ করে। আর যখন সে ভিড়ের একজন হয়ে যায়, তখন তার আচরণ হয় অন্য রকম। ব্যাপারটা নজরে পড়েছিল গুস্তাভ লে বঁ নামের ফরাসি পণ্ডিতের। চেনাজানা নিরীহ মানুষ যখন ভিড়ের একজন হয়ে যায়, সেই মানুষটাকে অচেনা মনে হয়। দ্য ক্রাউড: আ স্টাডি অব দ্য পপুলার মাইন্ড নামে গুস্তাভের বই ছাপা হয় ১৮৯৫ সালে। এই বইয়ে তিনি এই ভিড় করা মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝতে চান। অনেক একা মানুষ যখন কোনো মুহূর্তে এক হয়ে যায়, তখন তাদের মন মোটেও একলা মানুষের মনের মতো থাকে না। তার মন তখন ঠিক চেতন থাকে না। সব মানুষ মিলে কেমন এক বিশাল এক মনের মতো কাজ করে। এর লজিকই অন্য রকম। তাদের সিদ্ধান্তও হয় অন্য রকম। গুস্তাভ এই ভিড়কে পছন্দ করেননি। একে তাঁর মনে হয়েছিল কোনো আদিম প্রাণীর মতো। বিশাল, তার শরীর অতিকায়। কিন্তু বোধবুদ্ধি, যুক্তি বলে কিছু নেই।
গুস্তাভের এই বই খুব কাটতি হয়েছিল। এখনো আছে। ছাপা হওয়ার এক বছরের মধ্যে এর ১৯ ভাষায় অনুবাদ হয়ে যায়। দুনিয়াজুড়ে প্রেসিডেন্ট, স্বৈরশাসকেরা তাঁর ভক্ত বনে যান। হিটলার নিজে তাঁর অনুরাগী ছিলেন। মুসোলিনি তো গুস্তাভের পত্রমিতা ছিলেন। এখনো পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে রাজনৈতিক দাবি নিয়ে কোনো ভিড় দেখলে সেই বই থেকে উদ্ধৃতি দিতে ভোলে না।
এই মানুষের ভিড়কে বদনাম করতে পারলে ক্ষমতায় থাকা এলিটদের সুবিধা হয়। যুক্তরাজ্যজুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হলেন। যুক্তরাজ্যের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ভয় পেয়ে বললেন, ‘মব রুল ইজ রিপ্লেসিং ডেমোক্রেটিক রুল’। একই রকম জমায়েত দেখে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের দপ্তর থেকে সংসদ সদস্যদের এমন জমায়েতে না যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বিষয় নিয়ে নুসরাত সাবিনা চৌধুরীর একটা বই বের হয় ২০১৯ সালে। বইয়ের নাম প্যারাডক্সেস অব দ্য পপুলার: ক্রাউড পলিটিকস ইন বাংলাদেশ। এখানে নুসরাত নতুন দৃষ্টিতে ভিড়ের রাজনীতিকে দেখাতে চেয়েছেন। মোদ্দাকথা, তিনি বলতে চেয়েছেন যে এই ভিড়ের মানুষগুলো নিজেই এক রাজনৈতিক চরিত্র। এরা জনমানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো আলাপ থেকে সচেতনভাবেই এই চরিত্রের জন্ম হয়।
তবে একটা ব্যাপার এখানে লক্ষ করার মতো। ক্ষমতা এই ভিড়ের রাজনীতিকে ভয় পায়। আবার কাজেও লাগায়। যে মানুষগুলো কিছুদিন আগে মাজার ভাঙল, এরা একা কি এইভাবে ভাবত? তাহলে এই ভাবনার ধরন ঘুরিয়ে দিতে পারলে কোনো পক্ষের লাভ হতে পারে। গণজাগরণ মঞ্চের কথা ধরা যাক। শাহবাগের এক ভিড় থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইন বদলানোর দাবি উঠল। সে অনুযায়ী হাসিনা সরকার আইন বদল করল। এই দাবিতে যে বিশাল জমায়েত হয়েছিল, সরকার তাতে সমর্থন দিল, সহায়তা করল। সরকারের উদ্দেশ্য হাসিলের পরই সমর্থন প্রত্যাহার করা হলো।
রাষ্ট্রের মধ্যে যখন ক্ষমতা আর জনগণের সম্পর্কে অচলাবস্থা চলতে থাকে, তখন ঝটকা মেরে তার সমাধান করে দেন একজোট হওয়া মানুষ। এই হচ্ছে সেই ক্ষণ, যখন মানুষ হয়ে ওঠে জনতা। ২০২৪–এর জুলাই–আগস্টে আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। একটা দাবি যখন একটা ক্ষণে এসে এক হয়, তখন এর সামনে কোনো কিছুই দাঁড়াতে পারে না।
গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই ‘ক্ষণ’। ক্ষণকে যদি জীবন্ত রাখা যায়, তাহলে ভিড়ের মানুষ নিজেই একটা সচেতন চরিত্র হয়ে উঠতে পারে। প্রশ্ন হছে, কীভাবে সেই ক্ষণকে জীবন্ত রাখা যায়।
জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী