মধ্যরাতে হঠাৎই মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা আসে—‘এলাকায় ডাকাত পড়েছে, সবাই সচেতন হোন!’ লাঠিসোঁটা নিয়ে মানুষজন ডাকাত পাকড়াও অভিযান চালায়। মসজিদের মাইকের ওই আহ্বান ব্যক্তিগত সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। তবে বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বার্থ রক্ষা করতেও নাগরিকেরা অনেক বেশি সজাগ। সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন অসাধারণ রাজনৈতিক সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
সময় এখন উদ্দীপনার। আছে উৎকণ্ঠাও। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত গণ-অভ্যুত্থান মতপ্রকাশের অধিকার এবং বৈষম্যবিহীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। অন্যদিকে আছে আবার দুঃশাসনের রাজনৈতিক ফাঁদে পড়ার ভয়।
স্বাধীনতাসংগ্রাম ও বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল থাকে। বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ও অরাজকতা বৃদ্ধির আশঙ্কাও তৈরি হয়। তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রাষ্ট্র–কাঠামোর পুনর্গঠন। বাংলাদেশেও এখন এ বিষয়ে বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের মুরব্বিরা করণীয় নিয়ে রূপরেখা দিয়ে চলেছেন। উচ্চবর্গের এই নীতি আলোচনা থেকে দৃষ্টি সরালে আমরা দেখতে পাব সংকটময় পরিস্থিতিতে পাড়া, মহল্লা এবং এলাকাভিত্তিক সংকট মোকাবিলার বাস্তব ও মাঠভিত্তিক কর্মকাণ্ড।
এ উদ্যোগগুলো রাষ্ট্র সংস্কারের প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা থেকে আলাদা এবং পুরোপুরি স্থানিক। এলাকাভিত্তিক এ উদ্যোগগুলো মূলত রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জন্য জনগণের গায়ে খাটা কাজ। বিপৎকালে ওপরওয়ালা ও কর্তৃপক্ষের দিকে না তাকিয়ে নিজস্ব উদ্যোগে কাজ করা।
স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণমূলক এই কার্যক্রম বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার অংশ। কমিউনিটির সদস্যদের মধ্যে নিজ এবং কমিউনিটিকে রক্ষা করার স্পৃহা যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ক্ষেত্রেও কার্যকর হয়ে উঠতে পারে, তা–ই সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে উপলব্ধি করা যাচ্ছে।
আমরা সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে অংশীদার হতে দেখছি। তারা নিজ এলাকার সুরক্ষায় কমিউনিটির সবাই মিলে পাহারা দিচ্ছে, এলাকার রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালাচ্ছে, সহায়তা করছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে, গ্রাফিতি এঁকে জরাজীর্ণ দেয়ালের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে, দুর্যোগে উদ্ধারকার্য চালাচ্ছে, দিচ্ছে ত্রাণ। এর মধ্য দিয়ে জনগণের মাঝে পারস্পরিক আস্থা, সমঝোতা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লক্ষ করা যাচ্ছে এক অভূতপূর্ব ঐক্য।
শহুরে জীবনে আমরা আমাদের প্রতিবেশীর খেঁজখবরও রাখি না—এমন ধারণাই প্রচলিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সংকটময় পরিস্থিতে প্রতিবেশীদের দল বেঁধে রাতভর নিরাপত্তা টহল এ ধারণাকে অনেকাংশেই খণ্ডন করে। এলাকাভিত্তিক কাজ ব্যক্তিকে সহায়তা করছে বৃহত্তর সামাজিক নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হতে। ব্যক্তির সামাজিক পুঁজি তৈরি হচ্ছে। তারা পরিবার, কমিউনিটি ও রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করতে অনুপ্রাণিত হচ্ছে।
লক্ষণীয় যে কমিউনিটি উদ্যোগ পরিচালনার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষকে সংগঠিত হতে সহায়তা করেছে। তথ্য আদান-প্রদান, জরুরি সেবা দানকারীদের যোগাযোগের নম্বর আদান-প্রদান এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে কমিউনিটিভিত্তিক ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়েছে। জাতীয় সংকট মোকাবিলায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে পারস্পরিক অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
সাম্প্রতিক বন্যা মোকাবিলায় ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ এবং দুর্গতদের উদ্ধারের আহ্বান জানাতে দেখা গেছে। সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষ পূজার বাজেট কমিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর কথা জানাচ্ছেন! মসজিদের দান বাক্সের টাকা বন্যার্তদের দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা তাঁদের এক বা দুই দিনের আয় অনুদান দিয়েছেন। এমনকি শিশুরা নিজেদের মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে দিয়েছে। এভাবেই সাধারণ মানুষ যে যার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে।
সংকটময় পরিস্থিতিতে গুজব ছড়ানোর প্রয়াসও বিভিন্ন ইন্টারনেটভিত্তিক গ্রুপের মাধ্যমে প্রতিহত করতে দেখা গেছে সঠিক এবং প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে। এ রকম বহু স্থানীয় বা ব্যক্তিক উদাহরণ বাংলাদেশের বিভিন্ন সংকটময় পরিস্থিতিতে আমরা লক্ষ করেছি।
শহুরে জীবনে আমরা আমাদের প্রতিবেশীর খেঁজখবরও রাখি না—এমন ধারণাই প্রচলিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সংকটময় পরিস্থিতে প্রতিবেশীদের দল বেঁধে রাতভর নিরাপত্তা টহল এ ধারণাকে অনেকাংশেই খণ্ডন করে। এলাকাভিত্তিক কাজ ব্যক্তিকে সহায়তা করছে বৃহত্তর সামাজিক নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হতে। ব্যক্তির সামাজিক পুঁজি তৈরি হচ্ছে। তারা পরিবার, কমিউনিটি ও রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করতে অনুপ্রাণিত হচ্ছে।
ব্যক্তির এই কমিউনিটিভিত্তিক উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ততা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই তা যেন টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, সে ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে এখানে ঝুঁকিও আছে। কমিউনিটি উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলে কমিউনিটির উন্নয়ন এবং সংকট মোকাবিলায় গ্রহণ করা উদ্যোগে অংশগ্রহণের জন্য ব্যক্তির দায়বদ্ধতার অনুভব কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এই কমিউনিটিভিত্তিক উদ্যোগগুলো অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তি-উদ্যোগনির্ভর হওয়াই ভালো।
তবে শক্তিশালী ও সচেতন কমিউনিটি গঠনের জন্য প্রশিক্ষণ এবং কমিউনিটির মানুষের মতপ্রকাশ করার মাধ্যম তৈরি করতে হবে। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিদ্যমান নীতিগুলো যথাযথ বাস্তবায়নের উদ্যোগও প্রয়োজন। এতে তৈরি হবে সচেতন ও ক্ষমতায়িত কমিউনিটি।
এই কমিউনিটি অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সংকটকালে মতামত প্রদান করতে পারবে। কমিউনিটির সদস্যরা এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব দূরীকরণ, দুর্নীতি দমন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সহিংসতা মোকাবিলাসহ নানা চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে সব পর্যায়ের কমিউনিটির সর্বাত্মক সহায়তা জরুরি। এই আকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো অর্জিত হতে হবে স্থানীয় পর্যায়ে, স্থানীয় জনগণ ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমে এবং সর্বোপরি সমন্বিত উদ্যোগে।
মাধুরী গোস্বামী বাংলা কনটেন্ট এডিটর, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
তাসলিমা আক্তার রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি