আমরা কি একটা কেন্দ্রীয় গবেষণাগার খুলতে পারি না

আমরা তো কত টাকাই কত জায়গায় খরচ করছি—উৎপাদন-অনুৎপাদনশীল খাতে। কেন্দ্রীয়ভাবে কি একটা গবেষণাগার খোলা যায় না?ফাইল ছবি

কয়েকদিন আগে আমেরিকা থেকে এক চিকিৎসক টেলিফোন করেছিলেন আমার এআই নিয়ে লেখাটা পড়ে তাঁর মতামত জানানোর জন্য। চিকিৎসক ভদ্রলোক একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। তিনি বললেন, বর্তমান যুগে ইলেকট্রনিকসের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে চিকিৎসাক্ষেত্রে। তিনি জানান, কিছু রোগী আছেন, যাঁরা ওষুধ খেতে ভুলে যান, তাঁদের দেহে বা পাকস্থলীতে শোষণযোগ্য মাইক্রোচিপসের একটি ক্যাপসুল খাইয়ে দেওয়া হয়। চিপস থেকে শরীরে বসানো একটা প্যাচ অ্যান্টিনার মাধ্যমে রোগীর ওষুধ গ্রহণের উপাত্ত তার চিকিৎসার তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত হয়।

এ প্রসঙ্গে প্রায় বছর দশেক আগে আইইউটির এক ছাত্রের চতুর্থ বর্ষের একটা প্রজেক্ট উপস্থাপনার কথা মনে পড়ল। ছাত্রটি একটা কনসেপ্টের প্রস্তাব দিলেন। তিনি বললেন, মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর সুস্থ কার্যক্রমের ডেটা সংগ্রহ করে একটা মাইক্রোচিপে সংগ্রহ করে রেখে তা মানবদেহে স্থাপন করা হবে। তারপর দেহের সব সময়ের রিয়েল টাইম ডেটা সেন্সর দিয়ে ওই চিপে পাঠানো হবে। চিপে সংরক্ষিত ডেটার সঙ্গে প্রেরিত সংকেত সব সময় ন্যানোসেকেন্ডের ব্যবধান নিয়ে বিশ্লেষণ করতে থাকবে।

কোনো সুস্থ অবস্থার ডেটার সঙ্গে গরমিল হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সতর্কসংকেত পাঠাবে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হলে জিপিএস দিয়ে অবস্থান শনাক্ত করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দ্রুত চিকিৎসালয়ে এনে চিকিৎসা দেবে। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, অতি সংবেদনশীল কিছু ব্যক্তির জন্য এ ব্যবস্থা খুবই জরুরি। যেমন বিমানের পাইলট, বাসের ড্রাইভার বা এ ধরনের যানবাহন পরিচালনাকারীদের জন্য, যাঁদের মুহূর্তের অসুস্থায় অনেকগুলো মানুষের জীবনাবসান হতে পারে।

আসলেই সারা বিশ্বে মেডিকেল ইলেকট্রনিকসের ব্যবহার অতি দ্রুত বেড়ে চলেছে। দেশের অনেক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এ বিষয়ের ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা অতি ক্ষুরধার আর তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন। আমরা পারছি না তাঁদের ধরে রাখতে। এটা তো সত্য, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজগুলোসহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর অনেক ছাত্রছাত্রী স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এমন কোনো পরিসংখ্যান আছে কি, যেখান থেকে জানা যাবে, তাঁদের মধ্যে কতজন দেশে আছে। আমি প্রকৌশল বিষয়ের শিক্ষক। আমি বলতে পারি, আমার ছাত্রছাত্রীদের বেশির ভাগ দেশের বাইরে চলে গেছেন এবং এখনো যাচ্ছেন।

শিক্ষকতা করছি ৩৬ বছর হলো। ছাত্রছাত্রীদের সফলতার খবরে মন খুশিতে ভরে ওঠে। তাঁরা দেশের বাইরে অনেকভাবে সফল। তাঁদের হাতে উন্নত দেশের পাসপোর্ট। কিন্তু মাতৃভূমির উচ্চ মর্যাদা দেখে যেতে খুব ইচ্ছা করে। স্বপ্ন তো অনেক দেখি। স্বপ্ন দেখা আর দেখানোর দায়িত্ব শিক্ষক হিসেবে যে নিজের কাঁধেই নিয়েছি।

আমরা একটা স্বাধীন জাতি। মানমর্যাদায় সারা বিশ্বে আমাদের কী অবস্থান, তা নিশ্চয় এখানে লেখার দরকার নেই। দেশের বাইরে পা ফেললেই তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করা যায়। মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে মাথা তুলতে হলে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। বিশেষ করে গণিতসহ বিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্বসহকারে শেখানোর ব্যবস্থা রাখা অতিজরুরি।

সবাই বিজ্ঞান ভালোবাসবে বা বিজ্ঞানমনস্ক হবে, এমনটা হওয়া উচিত নয় বা হবেও না। তবে মাধ্যমিকের পর বাছাই করে নেওয়া যেতে পারে একটা অতি প্রতিভাবান গ্রুপকে। তাদের আলাদা করে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষা দিতে হবে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো।

আমার একটা প্রস্তাব আছে। বলতে পারেন একটা স্বপ্ন। আমরা তো কত টাকাই কত জায়গায় খরচ করছি—উৎপাদন-অনুৎপাদনশীল খাতে। কেন্দ্রীয়ভাবে কি একটা গবেষণাগার খোলা যায় না? বিশাল একটা ক্যাম্পাস নিয়ে জাতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র করা যায়, যেখানে আমন্ত্রণ জানানো হবে দেশি-প্রবাসী—সব অতি মেধাবীদের। তাঁদের দেওয়া হবে সবকিছু। অত্যন্ত আকর্ষণীয় বেতন-ভাতাদি। তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য স্কুল-কলেজসহ উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা। তাঁদের জন্য থাকবে আধুনিক হাসপাতাল, বিনোদনের ব্যবস্থা। গবেষকেরা নিশ্চিন্তে শুধু করবেন গবেষণা।

আমার বিশ্বাস, আমরা যদি তাঁদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে দিতে পারি, তাহলে অবশ্যই অসংখ্য নোবেলজয়ী তৈরি হবেন এ প্রতিষ্ঠানে। বিশেষ করে দেশের প্রয়োজনে যা যা দরকার, সবকিছুই তাঁরা উদ্ভাবন করবেন।

আরও পড়ুন

আজ একটা কথা খুব মনে পড়ছে। আমার এক বন্ধু ছিল পারস্য অঞ্চলের। তার দেশের সরকার তাকে পিএইচডি করতে কানাডায় পাঠায়। ওই অঞ্চলের মানুষজন গণিতে অসাধারণ প্রতিভাধর। আমরা একসঙ্গে কানাডায় এক ল্যাবে কাজ করতাম। সে বলেছিল, তাদের দেশে বিপ্লবের পর বছরের পর বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ছিল। তার দেশের ওপর স্যাংশনের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় যন্ত্রসহ অনেক কিছুর হঠাৎ বড়ই অভাব দেখা দিল।

ওই অবস্থায় সব টেকনোলজি ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রদের ওপর দায়িত্ব পড়ল দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করার। খেয়ে না-খেয়ে দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে তাঁরা তৈরি করতে লাগলেন একের পর এক নতুন যন্ত্রপাতি। আজ নিজেদের প্রতিরক্ষা তারা নিজেরাই করতে পারে। টেক্কা দিচ্ছে সব বড় বড় পরাশক্তির সঙ্গে।

শিক্ষকতা করছি ৩৬ বছর হলো। ছাত্রছাত্রীদের সফলতার খবরে মন খুশিতে ভরে ওঠে। তাঁরা দেশের বাইরে অনেকভাবে সফল। তাঁদের হাতে উন্নত দেশের পাসপোর্ট। কিন্তু মাতৃভূমির উচ্চ মর্যাদা দেখে যেতে খুব ইচ্ছা করে। স্বপ্ন তো অনেক দেখি। স্বপ্ন দেখা আর দেখানোর দায়িত্ব শিক্ষক হিসেবে যে নিজের কাঁধেই নিয়েছি।

  • ড. মো. আশরাফুল হক
    ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অধ্যাপক