মতিউরকাণ্ড: ছেলে তুমি কার, মিথ্যা যেখানে সত্য!

এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে কোরবানির ঈদে ১৫ লাখ টাকা দামের ছাগল কেনার পর থেকে ‘ছাগল–কাণ্ড’ নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা চলেছে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে। একে একে বের হতে শুরু করেছে মতিউর রহমানের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার কাহিনি। তাঁর ছেলেমেয়ে কোটি টাকা দামের গাড়ি চালায়। বিদেশে প্রাসাদ বাড়িতে থাকে। দেশে নিজ এলাকায় গড়ে তুলছে সাম্রাজ্য।

মতিউরের সাম্রাজ্য যখন সাধারণ মানুষের সামনে ফাঁস হতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই মতিউর রহমান বলে বসলেন, ‘এই ছেলে আমার না!’ অর্থাৎ ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনা ওই ছেলেকে তিনি দিব্যি অস্বীকার করে বসলেন! কানাডায় থাকা তাঁর মেয়েও সামাজিক মাধ্যমে লিখেছে, ওই ছেলে তার বাবার সন্তান নয়!

অথচ সাংবাদিকেরা ঠিকই খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, ওই ছেলে মতিউরের সন্তান। তিনি দুই বিয়ে করেছেন। ছেলে অন্য পক্ষের সন্তান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মতিউর রহমান কেন এই কাজ করলেন? কেন তিনি নিজের সন্তানকে রীতিমতো অস্বীকার করে বসলেন? এত বড় মিথ্যা তিনি কী করে বলে বসলেন? কেন তিনি মনে করলেন এমন একটা মিথ্যা বললে কাজ হয়ে যাবে?

আরও পড়ুন

উত্তরটা খুব সহজ। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, অতীতেও তিনি অনেক মিথ্যা বলেছেন। সেসব মিথ্যা বলে তিনি নিশ্চয় পার পেয়ে গিয়েছেন। তাই হয়তো ভেবেছিলেন, মিথ্যা বলে এবারও পার পেয়ে যাবেন। কিছু উদাহরণ বরং দেওয়া যাক।

এই মতিউর রহমান অতীতে একবার টেলিভিশনে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। সে খুব ইমানদার ছেলে। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। প্রতি সপ্তাহে রোজা রাখে।’ অর্থাৎ তিনি তাঁর ছেলেকে একজন মেধাবী ও ধার্মিক সন্তান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন টেলিভিশনে।

কেউ কি তখন মতিউরকে প্রশ্ন করেছে, আপনার ছেলে আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করে পড়াশোনা করতে গিয়েছে? সে তো স্কলারশিপে পড়তে যায়নি। তাহলে তার টিউশন ফি কে দিচ্ছে? কী করে সেখানে থাকা–খাওয়ার খরচ জোগাড় করছে? আপনার বেতনই–বা কত? একজন সরকারি কর্মকর্তা কি চাইলেই তাঁর সন্তানকে কোটি টাকার টিউশন ফি দিয়ে পড়াতে পারেন?

দেশের সাধারণ মানুষের নসিব কেড়ে নিয়ে তারা নিজেরা নসিব বানায়। সাধারণ মানুষ ডিম, পেঁয়াজ, নুন কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস তুলছে। বর্ষায় চাল ফুটো বাসায় থাকতে গিয়ে নিজেদের ভাগ্যকে দুষছে। অথচ তারা জানেও না কিংবা অনেকে বুঝতেও পারছে না তাদের এই অবস্থার জন্য ভাগ্য নয় মতিউরের মতো মানুষেরাই দায়ী।

তিনি দিব্যি এসব বলে পার পেয়ে গিয়েছেন। কেউ এসব প্রশ্ন করেনি। নিজেকে তিনি ধার্মিক বলে বেড়াতেন; ঠিক যেমনটা নিজের ছেলে সম্পর্কে বলে বেড়িয়েছেন। তার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রীতিমতো প্রাসাদ বানিয়ে রেখেছেন। সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসায় দান করে রীতিমতো দানবীর বনে গিয়েছেন!

অথচ প্রথম আলোতে খবর বের হয়েছে, এলাকার মানুষ বলেছে মতিউর রহমানের বাবা এবং পরিবার খুব একটা সচ্ছল ছিল না। যে জমিজমা ছিল, তা দিয়ে খেয়েপরে মোটামুটি চলত।

তাহলে এত সম্পদ তিনি করলেন কী করে? কীভাবে তিনি দানবীর বনে গেলেন? কেন কেউ প্রশ্ন করল না?

কারণ, মিথ্যা বলে তিনি হয়তো তখনো পার পেয়ে গিয়েছেন। এ কারণে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন নিজের ছেলেকে অস্বীকার করে মিথ্যা বলেও পার পেয়ে যাবেন! যে মানুষটা নিজের অপরাধ ঢাকতে নিজের ছেলেকে পর্যন্ত অস্বীকার করে, সেই মানুষটাই এত দিন নিজেকে ধার্মিক এবং নিজের ছেলেকেও ধার্মিক বলে বেড়িয়েছেন!

যে ছেলে লাখ টাকার ছাগল কিনেছে। কেনার পর তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছে ছাগল সম্পর্কে। তিনি বলেছেন, ‘এই ছাগল আমার নসিবে ছিল। শুকরিয়া!’

মতিউর রহমানের গ্রামের দোতালা ভবন
ছবি : প্রথম আলো

এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এই নসিব তিনি কোথা থেকে পেয়েছে? বাবার দেওয়া নসিব নিশ্চয়? তার বাবা কোথা থেকে পেয়েছেন এমন নসিব? যেখানে তাঁর ছেলে বছর বছর লাখ লাখ টাকা দামের কোরবানি দেয়। মেয়ে কানাডায় গিয়ে বিলাসবহুল জীবন যাপন করে। স্ত্রী বিনা ভোটে এলাকায় চেয়ারম্যান বনে গিয়ে ওয়ান্ডার পার্ক বানিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারে!

এত এত নসিব তারা কোথা থেকে পায়?

দেশের সাধারণ মানুষের নসিব কেড়ে নিয়ে তারা নিজেরা নসিব বানায়। সাধারণ মানুষ ডিম, পেঁয়াজ, নুন কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস তুলছে। বর্ষায় চাল ফুটো বাসায় থাকতে গিয়ে নিজেদের ভাগ্যকে দুষছে। অথচ তারা জানেও না কিংবা অনেকে বুঝতেও পারছে না তাদের এই অবস্থার জন্য ভাগ্য নয় মতিউরের মতো মানুষেরাই দায়ী।

যারা কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়ে এর কিছু টাকা দানখয়রাত করে রীতিমতো দানবীর বনে যাচ্ছে! অথচ সেই দানবীররা যে একেকজন দানব! সেটা হয়তো অনেকে বুঝতেও পারছে না।

আশার কথা হচ্ছে, মানুষ আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছে কেন তাদের ভাগ্য এমন হলো? কেন সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরও বেঁচে থাকার খাদ্য টুকু জোগাড় করা যায় না। তারা বুঝতে শুরু করেছে—অন্য এক দল কিছু না করেই তাদের ভাগ্য কেড়ে নিচ্ছে। একটা সময় সাধারণ মানুষ এদের দানবীর নয়; দানব ভাববে। এদের ঘৃণা করবে। রুখে দাঁড়াবে। এই আশা তো করাই যায়।

  • ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: [email protected]