অনেক দিন হলো আমরা ক্লাসে যাই না। শ্রেণিকক্ষগুলো ফাঁকা পড়ে আছে, বেঞ্চগুলোয় পড়ে গেছে ধুলার স্তর। ভাবতেই একরাশ হতাশা, গ্লানি আর অনিশ্চয়তা গ্রাস করে বসে আমাদের। ছাত্ররা সবাই শ্রেণিকক্ষে ফিরবে। কিন্তু থাকবে না মুগ্ধ, সাঈদ, হৃদয়, ফারাজের মতো তরুণেরা। তাদের রক্তের ওপরে হেঁটে আসা আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠবে, থাকবে একরাশ শূন্যতা।
কিন্তু আমরা শঙ্কিত এ–ই ভেবে যে আসলেই কি আর আগের সেই মধুর, ভালোবাসার আর সম্মানের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে আমরা ফিরে যেতে পারব?
যে তীব্র অভিমান, ক্ষোভ, হতাশা আর প্রতিবাদের উচ্চারণ নিয়ে এক মাস ধরে যাত্রা আমাদের ছাত্রদের, সেখানে কি আসলেই খুব স্বাভাবিক একটা অবস্থায় রাতারাতি ফিরে যাওয়া যাবে?
যখন শিক্ষার্থীদের হত্যা, গুলি, গ্রেপ্তার চলেছে, তখন দেশের অনেক শিক্ষক চুপ ছিলেন—এমন অভিযোগ আমাদের শিক্ষার্থীদের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই যদি মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়, তাহলে এই অভিযোগ অস্বীকার করার উপায় নেই।
এখন গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে ছাত্ররা বিভিন্ন শিক্ষকের পদত্যাগ চাইছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষককে তারা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। বেশ কিছু শিক্ষককে জোর করা হচ্ছে চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য। এমন অবস্থায় আসলেই কি শিক্ষার আগের পরিবেশে ফিরে যাওয়া সম্ভব?
ছাত্রদের এই ফুঁসে ওঠা আসলে গত ৫০ বছরের জমে থাকা তীব্র ক্ষোভের বিস্ফোরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লেকচার অপছন্দ হলে তা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই, কাউকে কোনো কোর্সের জন্য উপযুক্ত মনে না হলে সেটা জানানোর কোনো ব্যবস্থা নেই, শিক্ষক নিয়োগে নেই কোনো স্বচ্ছতা আর আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রতিফলন।
সিলেবাস নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে কি না, পরীক্ষা ও ফলাফল এক বছরের মধ্যেই হচ্ছে কি না, তা নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেই কোনো তদারকি। ছাত্রাবাসগুলোয় থাকতে দিয়েই যেন দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছে ছাত্রদের ব্যাপারে—এমনটাই অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোভাব।
ছাত্রাবাসের ক্রমাগত মান উন্নয়ন নিয়ে কেউ ভাবে না, খাবারের মান বাড়ানোর চিন্তা নেই কারও। হলগুলোকে রীতিমতো বর্গা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কাছে। এ যেন উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৭৩ অধ্যাদেশের দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছে অবাধ স্বাধীনতা আর কিছু শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারিতা ও দায়িত্বে অবহেলার প্রবণতা। আর এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের রাগের সম্মিলিত বিস্ফোরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
‘এত দিন কোথায় ছিলেন’, ‘তখন আপনাকে দেখি নাই কেন’, ‘গর্ত থেকে বের হয়েছেন’—এ রকম প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই শিক্ষকদের শুনতে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে।
শিক্ষকদের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে এটাও সবাইকে মনে রাখতে হবে— ফেসবুক মানে জীবন নয়। সবার সব আবেগ ফেসবুকে সবাই প্রকাশ করে না। এ রকম অসংখ্য শিক্ষক আছেন, যাঁরা ফেসবুকে লেখালেখি করতে পছন্দ করেন না কিংবা অভ্যস্ত নন।
আমরা ব্যক্তিগতভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষককে চিনি, যাঁরা আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেননি। আমরা এমন শিক্ষিকাকেও চিনি, যিনি ১ আগস্ট থেকে প্রতিদিন নিয়মিত রোজা রেখেছেন ছাত্রদের ওপর অমানবিকতা বন্ধ হওয়ার জন্য।
আমাদের অন্তত ৭৫ জন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের তৎক্ষণাৎ থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, যখন হঠাৎ করে ছাত্রাবাস থেকে তাদের বের হয়ে যেতে বলা হয়। অনেক শিক্ষকের মতে, ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসাটা অনুভূতির ব্যাপার, সেটা লোকদেখানো কিছু নয়।
আবার এটাও সত্য, ৫০ শতাংশ শিক্ষক ভয় পেয়েছেন সরাসরি কিছু বলতে বা লিখতে। তাঁকে গুম করা হতে পারত, হয়রানি শিকার হতে হতো, শিক্ষক সমিতিকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ার চাপ দিত সরকার, তথাকথিত নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য পুলিশ তাঁকে বা তাঁর পরিবারকে হয়রানি, মামলা, গ্রেপ্তার করতে পারত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হতে পারে—এ রকম অসংখ্য জুজুর ভয় কাজ করেছে অধিকাংশ শিক্ষকের মাথায়।
কারণ, গত ১৫ বছরে একের পর এক হয়রানি করা হয়েছে সত্য উচ্চারণ করা শিক্ষকদের। এই হয়রানির প্রতিবাদ করা শিক্ষকেরাও হয়েছেন বাধাগ্রস্ত বিভিন্ন কাজে।
করোনার সময়ে সৃষ্ট সেশনজট আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে আট মাস থেকে এক বছরের জট। সঙ্গে যুক্ত হলো তিন মাস ধরে চলা শিক্ষকদের আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান।
আমরা প্রায় দেড় বছরের শিক্ষাসংকটে পড়তে যাচ্ছি—এমনটাই আশঙ্কা। ছাত্রদের ক্লাসে ফিরে আসতে হবে। এখনই সব স্বাভাবিক হওয়া প্রয়োজন। কী করা যেতে পারে সবকিছু স্বাভাবিক করার জন্য?
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু আগে সব ব্যাচের সঙ্গে হোক মুক্ত আলোচনা। প্রতি সপ্তাহে দুই দিন প্রতিটি অনুষদে মেন্টাল কাউন্সেলিং সেশন আয়োজন করা হোক। ছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্য এ মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রদের অভিযোগগুলো মনোযোগ দিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে শোনা হোক।
আর কী রকম সংস্কার আশা করা উচিত ছাত্রদের? শিক্ষকদের পড়ানোর মান নিয়ে প্রতি সেমিস্টার বা বছর শেষে হোক টিচিং ইভ্যালুয়েশন, এক বছরের মধ্যে ক্লাস ও পরীক্ষা সমাপ্ত এবং ৪৫ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ (অন্যথায় জরিমানার ব্যবস্থা), ফলাফল অটোমেশন বা ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় প্রকাশ, প্রশাসনিক কাজ ও রেজিস্ট্রার অফিসে হয়রানি বন্ধে কার্যকর আইন ও তার প্রয়োগ, গণরুম, গেস্টরুম থাকবে না, বৈধতাবিহীন কোনো শিক্ষার্থী হলে থাকবে না, সব শিক্ষার্থী ছাত্রাবাসে বৈধ সিট পাবেন, নতুন ভর্তি হওয়া প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলে আবাসনের জন্য বেশি গুরুত্ব পাবে, ভিন্নমত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা হবে না। কাউকে কোনো রাজনৈতিক দলের ট্যাগ দেওয়া হবে না কথায় কথায়।
ভাঙনের জয়গান গাওয়া হোক। জীর্ণ–পুরোনো যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক। নতুন কিছুর শুরু হোক এভাবেই।
● আদনান মান্নান, মুশতাক ইবনে আয়ুব, এস এম মাহবুবুর রশীদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক