বেসরকারি চাকরিজীবীদের দেখার দায়িত্ব কার?

ফেসবুকের প্রচলিত একটা কৌতুক দিয়ে শুরু করছি: ‘স্বর্গের দরজায় তিন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ঈশ্বরের অলৌকিক বজ্রকণ্ঠ ভেসে এল—“তোমাদের মধ্য থেকে কেবল একজন ভেতরে আসতে পারবে”। প্রথম ব্যক্তি: আমি ধর্মপূজারি...স্বর্গে ঢোকার অধিকার আমার সবচেয়ে বেশি। ঈশ্বর নিশ্চুপ। দ্বিতীয় ব্যক্তি: আমি সমাজসেবক, সারা জীবন আপনার সৃষ্টির সেবা করেছি, তাদের দুঃখ দূর করেছি, স্বর্গে ঢোকার অধিকার আমারই বেশি। ঈশ্বর নিশ্চুপ। তৃতীয় ব্যক্তি: আমি সারা জীবন একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি...‘থাম’, ঈশ্বরের ধরা গলার আর্তনাদ ভেসে এল “আর একটা শব্দও বলবি না...আমারে কান্দাবি নাকি পাগলা...আয় ভেতরে আয়...তোর সারা জীবন বসের ঝাড়ি খাওয়া, পদোন্নতি না হওয়া, বছর শেষে বেতন না বাড়া, অফিস-রাজনীতি সামলানো, বিনা পয়সায় ওভারটাইম, রাত করে বাড়ি ফেরা, বাসে ঝুলে আসা-যাওয়ার কষ্ট, উইকেন্ডেতে বাসায় কাজ করা, পরিবারকে সময় না দেওয়া, সংসার চালানোর কষ্ট...কয়টা বলবো...সেন্টিমেন্টাল করে দিলি রে পাগলা...আয় ভেতরে...”’ মজা করে বলা হলেও এটাই আসলে বাস্তবতা। আমি এক বছর আগে এ নিয়ে লিখেছিলাম, এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

আরও পড়ুন

এখন সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৯%-এর কাছাকাছি। গত এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২৪%-এর কাছে (তা-ও সরকার দাম রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের সঙ্গে এখনো সমন্বয় করছে না), সোনার দাম বেড়েছে ৩০%-এর ওপর। তাহলে বাস্তব মূল্যস্ফীতি কীভাবে ৯%-এর কাছাকাছি থাকে? অভিজ্ঞজনদের মতে, বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতি স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এ অবস্থায় বেশির ভাগ সৎ আয়কারী মানুষের মতো বেসরকারি চাকরিজীবীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এর মধ্যে যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত, তাঁরা তাঁদের ‘দর’ বাড়িয়ে দিয়েছেন, কিছু চিকিৎসক/আইনজীবীরা তাঁদের ফি বাড়িয়ে নিয়েছেন, ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে নিয়েছেন জিনিসপত্রের, কিছু নিম্ন আয়ের মানুষ, তাঁরাও তাঁদের ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছেন (যেমন রিকশাওয়ালা); কিন্তু আমাদের, বেসরকারি চাকরিজীবীদের সেই সুযোগও নেই!! তাঁদের মালিকদের বলার অবস্থায় নেই!! বেতন বাড়ানো কর্তার ইচ্ছাতেই হবে। কিছু কোম্পানি মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তা তো সরকারি হিসাবে—বাস্তবতা থেকে বহুদূরে।

প্রথম আলোতে এর মধ্যে মানুষের ব্যয় কী পরিমাণ বেড়েছে, তা নিয়ে লেখা হয়েছে। ন্যূনতম যে পরিমাণ টাকার কথা বলা হয়েছে, তা কি বেশির ভাগ কর্মী পান? এখনো কিছু কোম্পানি অভিজ্ঞতা ছাড়া স্নাতক পাস ছেলে নিতে চায় পনেরো হাজারেরও কমে, এই ছেলে যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কত দিনে পড়ার খরচ উঠবে? অনেক দিনের দাবি ছিল, কর্মকর্তাদের ন্যূনতম বেতন ঠিক করা। বিভিন্ন পেশাজীবী সমিতির ভোটের সময়ও এ দাবি ওঠে। কিন্তু যেহেতু পেশাজীবীদের নেতারা বেশির ভাগ উঁচু পদের সরকারি কর্মকর্তা, তাঁরা এ কষ্ট আসলে বুঝতে পারেন না, চেষ্টাও দেখা যায় না। সরকার থেকে ন্যায্যমূল্যের যে জিনিসপত্র বিক্রি হয়—সেই সময় অফিস থাকে বেশির ভাগেরই। তাই কেউ যদি চক্ষুলজ্জা বাদও দেন, কিনে আনার সময় যে নেই।

আরও পড়ুন

এর মধ্যে একটা ভালো উদ্যোগ দেখা গেছে, সরকার থেকে পেনশন স্কিম চালু করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তা একটা ডিপিএসেরই নামান্তর, যেখান থেকে সরকার নিজেরই ফান্ড বাড়াবে। যাঁরা সরকারি চাকরি করেন, তাঁদের পেনশনের জন্য কি ডিপিএসের মতো টাকা দিতে হয়? তাহলে বেসরকারিরা কেন তাঁর বেতন থেকে দেবেন? প্রভিডেন্ট ফান্ড বললে বরং মানা যেত। আর একটা উদাহরণ, গ্রিস যখন আইএমএফের কাছে অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য ধার নেয়, তখন গ্রিস পেনশনের টাকা পরিশোধ না করে নিজেদের খরচ চালিয়েছিল। তাই কিছু করার আগে সবকিছু গুছিয়ে করা ভালো।

চাকরিজীবীদের পারসোনাল ইনকাম ট্যাক্সের ৯০% আসে এ বেসরকারি খাত থেকে, জিডিপিতে বেসরকারি খাত থেকে আসে প্রায় ৮০%। তাই এক দেশে দুই রকম নিয়ম করা উচিত নয়। সরকারের খুব ভালো করার ইচ্ছা থাকলে—সব কোম্পানির জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ও হেলথ ইনস্যুরেন্স বাধ্যতামূলক করে দেওয়া। সরকারের উচিত প্রস্তাবিত ‘পেনশন স্কিম’ সংশোধন করে যাঁরা ট্যাক্স দিচ্ছেন, তাঁদের ট্যাক্সের টাকা থেকে একটা অংশ পেনশন স্কিমে রাখা। আর যাঁরা ট্যাক্স দিতে পারেন না, তাঁদের জন্য একটা ফান্ড করতে পারে। আরও ভালো হয়, ট্যাক্স থেকে সবার জন্য পেনশন স্কিমের সঙ্গে সঙ্গে হেলথ ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা করে দেওয়া। আমাদের আয়করমুক্ত আয়ের নিম্নসীমা মাত্র ৩ লাখ। যা আসে পাশের যে বেশির ভাগ দেশের থেকেই কম (ভারতে ৬ লাখ রুপি)। আমরা যাঁরা ট্যাক্স দিই, সরকারের কাছ থেকে কিছু সুযোগ তো প্রাপ্য। কিছু সুযোগ দিলে মানুষের মধ্যে ট্যাক্স দেওয়ার উৎসাহ বাড়বে, সরকারেরও আয় বাড়বে।

দেশের বেসরকারি খাতকে একটা কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো সময়ের দাবি। ব্যবসায়ীদের একটা নিয়ম হচ্ছে, তাঁরা তাঁদের লাভ কমাতে চান না। যখন আয় কমে যায়, খরচ কমানোর জন্য চায়ে দুধ বাদ দেওয়া থেকে শুরু করে মানুষ বাদ দেওয়া সবই চলে। আর এই হুটহাট ছাঁটাই ঠেকানোর জন্য তাদের জন্য একটা আলাদা আইনি কাঠামো খুব জরুরি। এখন ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। মানুষ ছাঁটাইও চলছে অনেক। দেশে অপরাধের মাত্রা বাড়ার একটা কারণ, চাকরি না থাকা। (খবরের হেডলাইনে দেখা যায়—   ‘ডাকাতেরা কথা বলছিল শুদ্ধ ভাষাতে’ অথবা ‘বাচ্চার দুধ কিনতে ছিনতাই’!!)

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, যেসব দেশে চার কর্মদিবস চালু করেছিল তারা দেখেছে, এর ফলে খরচ কমেছে, মানুষের কাজের মানেরও উন্নয়ন পাওয়া গেছে। আমাদের দেশের মালিকেরা অনেকেই ৬ দিন ৮ ঘণ্টার ওপর কাজ করান। তিন দিন না হোক দুই দিন ছুটি দিলেও বেশির ভাগ কোম্পানিতে মানুষ ওই কাজ ৫ দিনেই করে ফেলতে পারবে। কিন্তু মানুষদের এই ‘বার্ন’ করা ঠেকাতে পারবেন আর অফিস খরচ ও কমে। আর যেসব অফিসে হোম অফিস সম্ভব, হোম অফিস দিলে জ্যামের কষ্ট লাঘব হয়, আর খরচ কমে মহামূল্য পেট্রল-ডিজেলের। কোম্পানির মালিকেরা—বেতনে যখন সুযোগ দিতে পারছেন না, অন্য কোথাও তো কিছু সুবিধা দিয়ে দেখুন। ভালোভাবে ম্যানেজ করতে পারলে, আপনাদেরই লাভ হবে।

বেসরকারি লোকজন তো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেই। এর মধ্যে মেয়েরা হচ্ছে আরও বেশি। আইএলওর প্রতিবেদন অনুসারে, ছেলেদের থেকে মেয়েদের এখনো বেতন প্রায় ৩৫% কম। এ ছাড়া মাতৃত্বকালীন ছুটিতে গেলে অনেক অফিসের ছাঁটাই করে দেওয়ার উদাহরণ আছে, যা চরম অমানবিক।

গত এক বছরে সরকার পাচার হয়ে যাওয়া এক টাকাও ফেরত আনতে পারেনি; বরং এর মধ্যেও সুযোগ পেলে সুযোগসন্ধানীরা নিয়েছে। এত এত টাকা যদি দেশেই বিনিয়োগ হতো, আজ দেশের বেসরকারি খাত হয়তো আরও রমরমা থাকত। কিন্তু পাচারকারীদের অপরাধের দায়ভার টানতে হচ্ছে এখন বেসরকারি খাতের মানুষদের, সৎ সরকারি কর্মকর্তাদের আর নিম্ন আয়ের মানুষদের।

এখন দেশে বেকারত্বের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। সরকার যদি বেসরকারি খাতকে কিছুটা সুযোগ দিত, তারা কর্মসংস্থান করতে পারত। বৈধ, অবৈধ বিদেশিদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, মানবসম্পদের উন্নয়ন, সিএসআরে যেমন কর ছাড়, নিয়োগের ক্ষেত্রে কর ছাড়ের ব্যবস্থা, এ রকম বেশ কিছু সুযোগ করতে পারলে দেশেরই উপকার হতো। সরকার ব্যাংক লোনে কম সুদের হার রাখছে, নতুন বিনিয়োগের জন্য। আবার ডলার-সংকটের জন্য এলসি করে মূলধনী সামগ্রী আনা যাচ্ছে না, তাহলে বিনিয়োগ কীভাবে হবে? কম সুদ তো দেশের কোনো কাজে লাগছে না। বিদেশিদের আকর্ষণের জন্যও নতুন কিছু দেখাতে পারছি না। তাই নিজেদের উপযোগী কর্মসংস্থান পরিকল্পনা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত এক বছরে সরকার পাচার হয়ে যাওয়া এক টাকাও ফেরত আনতে পারেনি; বরং এর মধ্যেও সুযোগ পেলে সুযোগসন্ধানীরা নিয়েছে। এত এত টাকা যদি দেশেই বিনিয়োগ হতো, আজ দেশের বেসরকারি খাত হয়তো আরও রমরমা থাকত। কিন্তু পাচারকারীদের অপরাধের দায়ভার টানতে হচ্ছে এখন বেসরকারি খাতের মানুষদের, সৎ সরকারি কর্মকর্তাদের আর নিম্ন আয়ের মানুষদের। ৮০% মানুষের অবস্থান যদি খারাপ হতে থাকে, তাহলে এত এত জিডিপি আর মাথাপিছু আয় নিয়ে আমরা কী করব?

সুবাইল বিন আলম, স্থিতিশীল উন্নয়নবিষয়ক কলাম লেখক।
ই-মেইল: [email protected]