চীনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে কারণে ব্যর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে ঘিরে চীনের সামরিক মহড়া
ছবি: এএফপি

এ বছরের জুলাইয়ে আসপেন সিকিউরিটি ফোরামে (আমি সেখানকার কো-চেয়ারম্যান) যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত কিং গ্যাং তাঁর দেশকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য আবেদন জানান। কিন্তু উপস্থিত বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চীনের উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে ভালো বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সিনথেটিক জীববিজ্ঞানের মতো ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির উন্নয়নে তাঁর দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীনের জিডিপি আগামী দশকের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে চীন কি কমিউনিস্ট শাসনের শততম বর্ষে (২০৪৯) যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে বিশ্বের ১ নম্বর শক্তি হতে চায়?

গত কয়েক দশকে সব ক্ষেত্রেই চীন উন্নতিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলপ্রণেতারা পরাশক্তির প্রতিযোগিতায় ‘জাতীয় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে আগামী তিন দশকে কী হতে যাচ্ছে, তা অজানা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ‘মধ্য আয়ের ফাঁদ’ থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হওয়ায় চীনের পতন শুরু হয়েছে। অন্যরা মনে করেন জনমিতিক বাধা, নিম্ন উৎপাদনশীলতা এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির চেয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়ার সির নীতির কারণে চীনের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া অসমতা ও পরিবেশদূষণের কারণে চীনকে অনেক বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাইওয়ান যুদ্ধ কিংবা অর্থনৈতিক সংকটে সির ‘চীন স্বপ্ন’ ভেঙে পড়তে পারে।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মেরুকরণ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা না গেলে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক বেশি ভুগতে হবে। চীনের সঙ্গে সফলভাবে প্রতিযোগিতা করতে হলে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্য আনার বিকল্প নেই। কিন্তু ঘরের রাজনীতিতে এত সমস্যা জিইয়ে রেখে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া কঠিন।

আসপেনের কিছু বিশেষজ্ঞ আবার মনে করেন, একক ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, সব সময়ই অনেকগুলো সম্ভাবনা থাকবে। আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে, চীন কী পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সাড়া দিচ্ছে, সেটার ওপরই নির্ভর করবে। অনেকগুলো সম্ভাবনা থাকার পরও চীনের চ্যালেঞ্জে সাড়া দিতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বিচক্ষণ কৌশল অনেক বেশি জরুরি।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নাটকীয় ব্যর্থতা হতে পারে বড় একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। ধরা যাক, যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জিতে গেল, কিন্তু সেই লড়াইয়ে অনেক বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে দেশটি। আসপেনের নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের ভারকেন্দ্র হতে পারে তাইওয়ান। তাইওয়ান যাতে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা না করে এবং দ্বীপটিতে যাতে চীনের সেনাবাহিনী বল প্রয়োগ না করে, সেই চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। চীন তার দেশে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। আবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও কখনো বলেননি যে তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বদল হয়েছে। চীনা কর্তৃপক্ষ দাবি করে আসছে, প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তাইওয়ান সফর যুক্তরাষ্ট্রের সেই নীতিকে খাদের ভেতরে নামিয়ে দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে ইউরোপের প্রধান শক্তিগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে যেভাবে হোঁচট খেয়েছিল, সেই ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারেন।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের রাজনীতিতে চীনকে ‘শয়তান’ হিসেবে চিত্রিত করার যে প্রচেষ্টা, তা দীর্ঘস্থায়ী শীতল যুদ্ধে ইন্ধন জোগাচ্ছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দ্বিতীয় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। এ ধরনের ঘটনা বিশ্ব অর্থনীতি পরিচালনায় চীন-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা কিংবা প্রতিবেশগত সংকট মোকাবিলায় দুই দেশের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এমনকি বিশ্বে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ এবং জৈব অস্ত্র কমানোর ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। এতে সবাইকে ভুগতে হবে।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মেরুকরণ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা না গেলে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক বেশি ভুগতে হবে। চীনের সঙ্গে সফলভাবে প্রতিযোগিতা করতে হলে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্য আনার বিকল্প নেই। কিন্তু ঘরের রাজনীতিতে এত সমস্যা জিইয়ে রেখে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া কঠিন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে জনতুষ্টিবাদী স্বাদেশিকতা বেড়েই চলেছে। এর ফলে অভিবাসন যেমন কমেছে আবার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জোটে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়াও কমেছে। এ ঘটনা প্রতিযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা ডেকে আনছে।

পরিশেষে দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যর্থতা ডেকে আনতে পারে। চীনকে মোকাবিলায় একটা সফল কৌশল প্রণয়ন করতে হলে বাস্তবতা ও বিচক্ষণতার সমন্বয় ঘটানো দরকার। চীনকে গণতান্ত্রিক করার সামর্থ্য যুক্তরাষ্ট্রের নেই, চীনারা কেবল সেটা করতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের মতো দৃষ্টিভঙ্গির পরিচর্যা করা প্রয়োজন। কেননা, এই মতাদর্শের মাধ্যমে জবরদস্তি না করেই মানুষকে আকৃষ্ট করা যায়, তাতে যুক্তরাষ্ট্রই লাভবান হবে। এ কারণেই চীনের চ্যালেঞ্জ সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে প্রথম পদক্ষেপটা যুক্তরাষ্ট্রের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড তাঁর সাম্প্রতিক লেখা দ্য অ্যাভয়েডেবল ওয়ার: দ্য ডেঞ্জার অব আ ক্যাটোসট্রফিক কনফ্লিক্ট বিটুইন ইউএস অ্যান্ড সি চিন পিংস চায়না বইয়ে বিশ্বের প্রধান দুই শক্তির মধ্যকার ‘কৌশলগত প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ’ করার জন্য কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন। সংক্ষেপে চীনে জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং সি চিন পিং সরকারের আগ্রাসী নীতির মানে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিপক্ষের সমীকরণ বুঝতেই বেশি সময় ব্যয় করতে হবে। কিন্তু আমেরিকা যদি মতাদর্শিকভাবে চীনকে ‘শয়তান’ বানানো বন্ধ করে, শীতল যুদ্ধের মতো ভুল উপমা ব্যবহার না এড়ায় এবং জোট রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে, তাহলে চীনের দিক থেকে আসা চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক