রামুর পর নাসিরনগর। নাসিরনগরের পর সাঁথিয়া। সাঁথিয়ার পর কুমিল্লা। কুমিল্লার পর নড়াইল। একের এক সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। আর আমরা, এই দেশের সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মনে হয় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আক্রান্ত মানুষগুলো দুঃখে কাতর হচ্ছেন; কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না? তাদের একটাই আকুতি। কেন আমরা বারবার হামলার শিকার হব? প্রতিকার পাব না। অপরাধ ঘটবে অথচ অপরাধের শাস্তি হবে না। এটা কেমন কথা?
নড়াইলের ধর্মাবমাননার করে যে তরুণ ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন, পুলিশ গতকাল শনিবার রাতে তাঁকে খুলনা থেকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রথম আলোর খবরে বলা হয়; শনিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে খুলনা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গতকাল রাতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। আকাশ দিঘলিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী অশোক সাহার ছেলে। তিনি স্থানীয় নবগঙ্গা ডিগ্রি কলেজের স্নাতকের ছাত্র। তার আগে পুলিশ তাঁর বাবাকেও থানায় নিয়ে গিয়েছিল পরিস্থিতি শান্ত করতে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের দাবি, পরিস্থিতি শান্তই ছিল। নড়াইলের পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও লোহাগড়া উপজেলার ইউএনও সারা রাত সেখানে অবস্থান করছিলেন। পাহারায় মোতায়েন ছিলেন র্যাব ও পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্যও। এত কিছুর পরও কীভাবে লোহাগড়ার দিঘলিয়ার হিন্দুদের বাড়িঘরে কীভাবে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটল? তাহলে কি যাঁরা হামলা করেছেন, তাঁরা পুলিশ ও প্রশাসনের চেয়েও শক্তিশালী?
ধর্মাবমাননা বা কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া নিশ্চয়ই অপরাধ। কেউ অপরাধ করলে তাঁকে আইনের আওতায় আনা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সেই ঘটনা নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ভাঙচুর হবে কেন? কেন আগুন দেওয়া হবে? কেন মন্দিরে আক্রমণ করা হবে?
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে দীপালি সাহা বলেন, একদল লোক তাঁদের বাড়িঘরের সবকিছু লুট করে নেওয়ার পর আরেক দল এসে ঘরে আগুন দিয়েছে। যখন ঘরে আগুন দিচ্ছিল, ৬২ বছর বয়সী দীপালি রানী সাহা ছেলে গোবিন্দকে নিয়ে পাশের আরেকটি ঘরে বিছানার কাপড় মুড়ে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁরা যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘর খুলতে না পেরে দুর্বৃত্তরা পাশের মন্দিরে হামলা চালায় এবং প্রতিমা ভেঙে ফেলে।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, এলাকার পরিস্থিতি শান্ত রাখতে মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে। এলাকায় টহল দিচ্ছে র্যাব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। পুলিশের বিশেষ শাখা ও গোয়েন্দা শাখার সদস্যরাও সার্বক্ষণিক ওই এলাকায় অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা, জনপ্রতিনিধিরাও সেখানে আছেন। দিঘলিয়া সাহাপাড়ার বাসিন্দাদের কেউ কেউ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। তাঁদের অধিকাংশই হামলার পর বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ঘটনার পর থেকে দিঘলিয়া বাজারের দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায়। রোববার সকালে কিছু কিছু দোকান খুলেছে।
নড়াইলে সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে সমবেদনা জানিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা তাঁর ফেসবুকে যে বার্তা দিয়েছেন, তার ছিল মর্মস্পর্শী। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমরা নিজেরা বিভক্ত হয়ে পড়ব, আমি কখনোই ভাবতে পারি না। এই নড়াইলকে তো আমি চিনি না। ....গতকাল আমাদের এলাকায় এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, যা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে এবং প্রতিটি মুহূর্তে পোড়াচ্ছে।’ মাশরাফি ওই বার্তায় আরও বলেন, ‘ছেলেবেলা থেকে যে নড়াইলকে দেখে এসেছি, যে নড়াইলকে নিয়ে আমরা গর্ব করি, সেই নড়াইলের সঙ্গে এই নড়াইলকে আমি মেলাতে পারছি না। দেশে আইন আছে, প্রশাসন আছে, তারা ব্যবস্থা নেবে। কোনো পরিস্থিতিতেই আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারি না। অভিযোগ যদি সত্যিও হয়, একজনের জন্য গোটা সমাজের নিরপরাধ মানুষদের ওপর অন্যায় করার কোনো অধিকার কারও নেই। কেউ সত্যি অপরাধ করলে তার বিচার আদালত করবেন, তবে আমি-আপনি এ জন্য কাউকে কোনো শাস্তি দিতে পারি না।’ (প্রথম আলো, ১৭.৬. ২০২২)
লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া এলাকার এক কলেজছাত্র গত শুক্রবার বিকেলে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তি করে তাঁর ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় স্থানীয় বিক্ষুব্ধ লোকজন দিঘলিয়া বাজারে সংখ্যালঘুদের বাড়ি ও দোকানপাটে হামলা চালান। এ সময় একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন তাঁরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ একপর্যায়ে ফাঁকা গুলি করে।
মাশরাফি বিন মুর্তজা কেবল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেননি। তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রথম আলোয় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় যেই বাড়িটি সন্ত্রাসীরা পুড়িয়ে দিয়েছে, সেই বাড়ির মালিক গোবিন্দ সাহার মা দীপালি সাহার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁকে তাঁকে সান্ত্বনা দেন।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে দীপালি সাহা বলেন, একদল লোক তাঁদের বাড়িঘরের সবকিছু লুট করে নেওয়ার পর আরেক দল এসে ঘরে আগুন দিয়েছে। যখন ঘরে আগুন দিচ্ছিল, ৬২ বছর বয়সী দীপালি রানী সাহা ছেলে গোবিন্দকে নিয়ে পাশের আরেকটি ঘরে বিছানার কাপড় মুড়ে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁরা যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘর খুলতে না পেরে দুর্বৃত্তরা পাশের মন্দিরে হামলা চালায় এবং প্রতিমা ভেঙে ফেলে।
ডেইলি স্টারের ছবিতে দেখা যায়, অগ্নিদগ্ধ বাড়ির পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন দীপালি রানী সাহা। পাশে আরও কয়েকজন আক্রান্ত মানুষ। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, বাড়ির ভেতরের আসবাবপত্র, দরজা জানালা সব পুড়ে গেছে। দীপালি সাহা বলেন, ‘আমরা হিন্দু বলেই আমাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। যে তরুণ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তিনিও হিন্দু। তাঁর জিজ্ঞাসা, আমরা জানি না আর কত সহিংসতা আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে? কে আমাদের নিরাপত্তা দেবে?’ পুলিশ গতকাল সকালে এসে আমাদের নিশ্চয়তা দিল কিছু হবে না। আমি তাদের কাছে সহায়তা চাইনি। কিন্তু আমার ঘর পুড়ল কেন?’
প্রথম আলোর খবর থেকে জানতে পারি, সরকারি অর্থায়নে ক্ষতিগ্রস্ত গোবিন্দ সাহার বাড়ি মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যের উপস্থিতিতে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটল কীভাবে? স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, সেখানে আক্রমণকারীদের সংখ্যা বেশি ছিল না। তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে সাহা পাড়ায় হামলা করেছেন। এমনকি বিক্ষোভকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতকে অভিযুক্ত আকাশ সাহার বাবাকেও থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। তারপরও হামলার ঘটনা ঘটল কীভাবে? প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর সদস্যরা কী করেছিলেন? অনেকের অভিযোগ, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরই প্রশাসন সজাগ হয়। পাহারা জোরদার করে। এর অর্থ কি তারাই চেয়েছিলেন হামলা হোক?
এর আগে যেসব স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে, একই ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠেন। বড় বড় কর্মকর্তা আসেন। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে হুংকার ছাড়েন। কিন্তু ঘটনার আগে তারা অনেকটা নির্বিকার। এই ধারাই চলে আসছে। মাস খানিক আগে এই নড়াইলের আরেক তরুণের এক স্ট্যাটাস নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে চরমভাবে অপমান করা হয়। অথচ ওই স্ট্যাটাসের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না। কলেজের আরেক শিক্ষক, যিনি অধ্যক্ষের পদটি নিতে চান, শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়েছেন। সেই ঘটনার জের না কাটতেই লোহাগড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটল।
এর আগে রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর যাঁরা হামলা চালিয়েছিলেন, যাঁরা সেখানকার বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করেছিলেন, যাঁরা নাসিরনগরের ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়েছিলেন, যাঁরা কুমিল্লায় গত দুর্গোৎসবের সময় হিন্দুদের ঘরবাড়িও মন্দিরে হামলা চালিয়েছিলেন, তাঁদের কারও বিচার হয়নি।
প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে যারা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদেরই কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, আর কারও ধর্মীয় অনুভূতি নেই? এই যে লোহাগড়ায় হিন্দুদের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙা হলো, তাতে কি তাদের ধর্মীয় অনুভূতি আক্রান্ত হয়নি? তারা এর প্রতিকার পাবে কি? কেবল ভাঙা বা পুড়ে যাওয়া ঘর নির্মাণ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাদের ওপর হামলার ঘটনা বন্ধ করতে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মাশরাফি বিন মুর্তজাকে ধন্যবাদ জানাব। তিনি অন্য জনপ্রতিনিধিদের মতো কেবল বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি আক্রান্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার চেয়েও তিনি এই নড়াইল আমি চিনি না বলে এলাকাবাসীর বিবেক জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। কেবল নড়াইল নয়, গোটা দেশের বিবেক জাগ্রত হোক। বন্ধ হোক দীপালি রানীদের কান্না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি